১৬ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৯:৩২
সংবাদ শিরোনাম

শিক্ষাদানের মহান কারিগর সফল শিক্ষক ও অভিভাবক মোবারক স্যার

॥ মোঃ নজরুল ইসলাম ॥
  • আপডেট বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ৯০ বার পঠিত

যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।

তিন অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ-বিদায়। মাত্র তিন অক্ষর। কিন্তু শব্দটির আপাদমস্তক বিষাদে ভরা। শব্দটা কানে আসতেই মনটা কেন যেন বিষন্ন হয়ে ওঠে। এমন কেন হয়? কারণ এই যে, বিদায় হচ্ছে বিচ্ছেদ। আর প্রত্যেক বিচ্ছেদের মাঝেই নিহিত থাকে নীল কষ্ট। বিদায় জীবনে শুধু একবারই নয়, এক জীবনে মানুষকে সম্মুখীন হতে হয় একাধিক বিদায়ের। সে-ই যে জন্ম লগ্ন থেকে বিদায়ের সূচনা, তারপর জীবন পথের বাঁকে বাঁকে আরো কত বিদায় যে অনিবার্য হয়ে আসে।

মানবশিশু ভুমিষ্ঠ হয়েই কাঁদতে থাকে। কেন সে কাঁদে? সে তো কাঁদবেই। এতদিন মায়ের নাড়ির সঙ্গে তার যে বন্ধন ছিল সেটি যে আজ ছিন্ন হল। এভাবে জীবনের পরতে পরতে ছিন্ন হয় আরো কত প্রিয় বন্ধন! শিক্ষা জীবনের সমাপ্তিতে সহপাঠী ও প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেয়ার বিষয়টিও এমনি এক নিবিড় বন্ধন ছিন্ন হওয়া, যা খুব সহজে ভোলা যায় না। তবে এ বিদায়ের বেলায় কষ্টের মাঝেও এক রকম আনন্দ থাকতে পারে যদি সান্তনার সংকট না থাকে। এই সান্তনা শিক্ষাদান জীবনে সফলতার সান্ত্বনা। শেষ বিদায় যেহেতু সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে বিষাদের তাই জীবনের অন্যান্য বিদায়ের সময় শেষ বিদায়ের কথা স্মরণ করতে হবে। যাতে তখন কোনোরূপ পরিতাপ নিজেকে দগ্ধ না করে অতীত জীবনের কর্মের জন্য। তাহলেই জীবনের খন্ড খন্ড বিদায়গুলো সার্থক হয়ে উঠবে নিশ্চয়। মানবজীবনের সর্বশেষ যে বিদায় অবধারিত হয়ে আসে তার নাম মৃত্যু। মৃত্যু এমন এক বিদায়ের নাম, যার দিন-তারিখ কেউ বলতে পারে না। বলা সম্ভব নয়। কুরআন মজিদে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘কোনো মানুষ জানে না, সে আগামীকাল কী উপার্জন করবে এবং কোনো মানুষ জানে না, সে কোন স্থানে মৃত্যুবরণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ। তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।’-সূরা লোকমান ৩৪।

তবুও কিছু বিদায় খুব কষ্টের যা খুব সহজে মেনে নেওয়া যায় না। ২৫ ফেব্রুয়ারী-২০২৫ মঙ্গলবার অবসরের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানছেন তিনি শুধু একটি স্কুল কিংবা একটি এলাকার নন, তিনি হচ্ছেন বৃহত্তর সিলেট সদর উপজেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয়, আলোকোজ্জ্বল শিক্ষাদানের মহান কারিগর, হ্যাঁ, যার কথা লিখছি তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক, অভিভাবক মোবারক স্যারের কথা।

সিলেট শহরতলীর ৩নং খাদিম নগর ইউনিয়নের ধূপাগোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টানা ৩ যুগেরও বেশি সময় শিক্ষকতার মাধ্যমে অত্র অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের অনুকরণীয় অনুসরণীয় আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব মোঃ মোবারক হোসেন স্যার আমার দেখা এবং জানা একজন সফল মানুষ সফল শিক্ষক ও অভিভাবক। আমার সৌভাগ্য হয়েছে উনার মতো একজন মানুষের ছাত্র হিসেবে শিক্ষা গ্রহণ করার। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে এই অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা গ্রহণের জন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না, যেতে হতো সিলেট শহরে। সেটা দুঃসাধ্য ছিলো।

এই অঞ্চলের মানুষের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা দীক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে সুনাগরিক গড়ে তোলার প্রাথমিক সোপান একটি স্কুল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন আমার দাদা মরহুম হবিব উল্লাহ। এলাকার লোকজন কে নিয়ে পরামর্শ করে স্কুলের জন্য দান করেন উল্লেখযোগ্য ভুমি। সেখানেই গড়ে উঠে আজকের এই বিদ্যালয়। উনার স্বপ্ন ছিল এখান থেকে সুশিক্ষা গ্রহণ করে অত্র অঞ্চলের ছেলে-মেয়েরা বিশ্বজুড়ে সুনামের অধিকারী হবে। আমি মনে করি উনার সেই স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে।

আমার দাদা মরহুম হবিব উল্লা’র সেই স্বপ্নের যথার্থ সফল বাস্তবায়ন হয়েছে যেই মানুষটির হাত ধরে, সেই সফল মানুষটির নাম মোঃ মোবারক হোসেন। যে মানুষটি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন অত্র অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে। উনার নিপুণ হাতের স্পর্শে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও বিদেশে সুনামের সহিত কাজ করছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। উনার কর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ জেলা উপজেলা পর্যায়ে সরকার কর্তৃক পেয়েছেন একাধিক বার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এর মর্যাদা এবং অর্জন করেছেন অজস্র মানুষের ভালবাসা।

শিক্ষতার পাশাপাশি সদর উপজেলা স্কাউট লিডার মোবারক স্যার সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে যুবরা কিভাবে একজন দক্ষ লিডার, স্মার্ট উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে উনার সেই প্রচেষ্টার কথা অত্র অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ আজীবন শ্রদ্বার সাথে স্মরণ করবে।

স্যারের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ স্কুলে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে। তখন আমার ততটা বুঝ ছিলোনা। মনে পড়ে ৫ বছরের শিক্ষাজীবন এবং স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ভালবাসায় সফলতার সাথে ১নং রেজাল্ট করে প্রাইমারি স্কুল কে বিদায় জানালেও বিদায় নেইনি স্যারের স্নেহ, আদর, ভালবাসা, উৎসাহ এ অনুপ্রেরণা থেকে। প্রাইমারি পরবর্তী সময়ে আমার আমরা ভাই বোন সকলের শিক্ষা,কর্মসংস্থান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবখানেই রয়েছে স্যারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, যা লিখতে গেলে হাজারো পৃষ্ঠা শেষ হবে ; কিন্তু স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা শেষ হবে না। স্যারের আজকের এই বিদায়ী দিনে বারবার মনে পড়ছে আমার পিতার সাথে স্যারের সুখস্মৃতির কথা। ২০০৮ সালে আব্বা যখন প্রথম স্টোক করেন তখন বাসা থেকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া, ভর্তি করানো এবং প্রতি মুহুর্তের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সর্বপরি একজন অভিভাবকের ন্যায় পাশে দাড়িয়ে ছিলেন। শুধু একটি উদাহরণ তুলে ধরলাম, এরকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে মানুষের বিপদে পাশে দাড়ানোর। মরহুম লাল মিয়া, ধূপাগোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালীন এবং এর আগে থেকেও স্যারের সাথে রয়েছে আমাদের পরিবারের অসংখ্য স্মৃতি, যা আজীবন স্মৃতির স্মারক হিসেবে থাকবে হৃদয়ের গভীরে।

বিদ্যালয়ের পাশেই আমাদের বাড়ি থাকার সুবাদে দেখেছি, উনি একজন কর্মপিপাসু মানুষ, সৎ সাহসী, বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একজন মানুষ। অনেক জটিল বিষয় ও ক্রিটিক্যাল মুহুর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে অনেক ধৈয্যশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কখনো ধৈর্য্যহারা হতে দেখিনি। কাজকে কি করে ভালবাসতে হয়, আপন করে নিতে হয়, কাজকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হয়, তা উনার সানিধ্যে গেলে অনুধাবন করা যায়। একজন আদর্শ শিক্ষকের যত গুনাবলী থাকা দরকার তার সবটুকুই উনার মাঝে বিদ্যমান।

মোবারক স্যার আমার একজন আইডল। আমার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ইনসাফ ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ সোসাইটির উপদেষ্টা হিসেবে পেয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি উনি কতটা সহযোগিতার মনোভাবাপন্ন। নিজের প্রতিষ্ঠান হউক কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানের যেই উনার সাথে কাজ করেছেন সবাই উনার কর্ম দক্ষতা ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবে আন্দোলিত ও বিমোহিত হয়েছেন। প্রথম পরিচয় থেকে আজ অবধি স্যারকে কখনো ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেখেনি। তারুণ্যে ভরপুর সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল। শিক্ষার্থীদের ভালোবাসেন পিতার মত, তাদেরকে আপন করে নেন বন্ধুর মত।

জীবনে যতবার স্যারের সহযোগিতা চেয়েছি, ততবারই পাশে ছিলেন একজন অভিভাবকের মত। সৎ, পরোপকারী, দায়িত্বশীল এই শিক্ষক সবার কাছে আদর্শের। নিজে যেমন কাজকে ভালোবাসেন অন্যদেরকে ও অনুপ্রানিত করেন।
২৬/০২/২০২৫ তারিখে এই মহান শিক্ষক আনুষ্ঠানিক কর্মজীবনের ইতি টেনে অবসরে যাচ্ছেন। আমি জানি মোবারক স্যারের বিকল্প শুধু তিনিই। এই সামান্য লেখনিতে তাঁর সম্পর্কে লিখে শেষ করা যাবেনা।

মোবারক স্যার সবসময় একটি কথা বলতেন, যে কাজ-ই করেন না কেনো, মাথায় রাখবেন তোমার কাজ যেনো সবার থেকে ভালো ও উন্নত হয় আর প্রতিষ্ঠান হয় সেরা। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন বিদায় বেলায়। তিনি নিজে যেমন সেরা, ঠিক তেমনি ভাবে কর্মদক্ষতায় এই প্রতিষ্ঠানকে করেছেন সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সম্মানিত।

আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্যারকে বলতে চাই তিনি অনেকের মত আমার কাছেও অনুসরণীয়। আমি স্যারের অবসরকালীন জীবনের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি। মোবারক স্যারের আদর্শে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের জয় হউক, মহান আল্লাহর দরবারে এই কামনা করি।

লেখক : মোঃ নজরুল ইসলাম, প্রাক্তন ছাত্র ৯৪ ব্যাচ ধূপাগোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলেট সদর সিলেট।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2025 AkashBangla. Developed by PAPRHIHOST
Theme Dwonload From Ashraftech.Com
ThemesBazar-Jowfhowo