এহসানুল হক জসী
কানাইঘাটের জন্য মনে হয় এটা একটা দুর্ভাগ্যই বটে, এখানে এমন কিছু মনীষার জন্ম হয়েছে; যতটুকু তজল্লী ছড়ানোর কথা তাঁদের থেকে এর চেয়ে কম ছড়িয়েছে; তাঁদের কাছ থেকে দেশ ও জাতি উপকার পেলেও যতটা পাওয়ার কথা তার চেয়ে কম পেয়েছে। আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। তাঁর মনন-মনীষা থেকে দেশ ও জাতি কতটুকু নিতে পেরেছে? রাজনীতির উপর তিনি যে বই লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্য হওয়ার মতো বই হওয়া সত্ত্বেও সেই বই সম্পর্কে আধুনিক জগৎ সম্পূর্ণ না-ওয়াকিফ। আরেকজন ব্যক্তিত্ব হাফিজ মাওলানা আবু সাঈদ চৌধুরী সম্পর্কেও আমরা অনেকটা না-ওয়াকিফ। তিনি যে মাপের ইসলামিক স্কলার, বর্তমান সময়ে তাঁর মতো এমন আরেকজন মেধাবী ইসলামিক স্কলার কমই আছেন। কানাইঘাটে জন্মগ্রহণকারী এমন বিরল মেধার অধিকারী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আরেকদিন তুলে ধরবো, আজ কিয়দংশ।
হাফিজ মাওলানা আবু সাঈদ চৌধুরী একজন ইসলামিক স্কলার। ৮০ বছর বয়সী এই অনন্য মানুষটির জন্ম কানাইঘাট উপজেলার ৩ নং দিঘীরপার ইউনিয়নের দর্পনগর বাল্লা গ্রামে। তিনি ইসলামিক শরীয়া কাউন্সিল ইউকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইস্ট লন্ডন মসজিদের খতিব ছিলেন। দাওয়াতুল ইসলাম ইউকেরও আমীর ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এই সংগঠনে বার বার নির্বাচিত হয়েছেন। ইউকেতে দারুল ইসলাম মসজিদ এবং ইসলামিক সেন্টার উনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৃটেনে মুসলিম কমিউনিট গড়ে তুলার ক্ষেত্রে তাঁর বিরাট অবদান রয়েছে। ইউরোপে ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদান রয়েছে। লন্ডনে বা বৃটেনে ইসলামের খেদমতে যারা নিয়োজিত আছেন বা ইসলামের জন্য কাজ করেছেন, সেসব ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে উচ্চতার দিক থেকে তিনি একেবারে উপরেরই একজন। এই বাংলাদেশি আলেম সেই দেশে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম হিসেবে স্থান করে আছেন। ইয়েস, তিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী থেকে লন্ডন বাস করছেন।
মেধায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বি। সম-সাময়িক আলেম ও ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে তিনি প্রথম মাত্র ২৭ দিনে কুরআনের হাফিজ হন। গাছবাড়ী কামিল মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল হাফিজ মাওলানা আব্দুর রহীম ছাত্রজীবনে আবু সাঈদ সাহেবের জুনিয়র ছিলেন। মাওলানা আব্দুর রহীম ও তাঁর বন্ধু মাওলানা আলাউদ্দিনও ২৭ দিনে কুরআনের হাফেজ হয়েছিলেন আবু সাঈদ সাহেবের কুরআন হিফজের খবর পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে। শায়খুল হাদীস আব্দুর রহীম সাহেবের মতো ব্যক্তিও প্রভাবিত হয়েছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ স্কলার আবু সাঈদ সাহেবের দ্বারা।
মেধায় তিনি আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে, এককথায় সকল ক্ষেত্রে বরাবরই অনন্যতার প্রমাণ রেখেছেন। সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা আলমা-মেটারদের একজন। আলিয়ার সেরা ছাত্রদের মধ্যে যাদের বিবেচনা করা হয় তাদের মধ্যে রয়েছেন আহমদ আলী বদরপুরী, স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ঢাবি অধ্যাপক আবু সাঈদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ, কাজীরবাজার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান, হরমুজ উল্লাহ নারাইনপুরী, মাওলানা শফিকুল হক আকুনী, মাওলানা ফয়জুল বারী মহেষপুরী এবং মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। সেই পাকিস্তান আমলে এই আলিয়া মাদ্রাসার কৃতি ছাত্র ছিলেন আল্লামা আবু সাঈদ চৌধুরী। বোর্ড স্ট্যান্ড করে এই মাদ্রাসার সুনাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছেন। যেই সময় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া খুবই বিরল ঘটনা ছিলো সেই সময় তিনি ছাত্রজীবনে কোন পরীক্ষায় সেকেন্ড ক্লাস পান নাই। মাদ্রাসার ডিগ্রী নেওয়ার পর তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এই কলেজের সর্বোচ্চ মার্কস পাওয়াদের একজন তিনি। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য অনার্স ও মাষ্টার্স পাশ করেছেন এই বরেণ্য আলেম। সহজেই অনুমেয়, তিনি কত ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন।
হাফিজ মাওলানা আবু সাঈদ চৌধুরী শুধু ক্লাসের বা পড়ার টেবিলের একজন ভালো ছাত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি সেই সময় একজন ডাকসাইটে ছাত্রনেতাও ছিলেন। একজন অবিসংবাদিত ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি অবিভক্ত সিলেট জেলার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাও ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক বা তিনি যাদের সাথে রাজনীতি করেছেন, তাঁর সমকক্ষ সেই ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ মন্ত্রী হয়েছেন, জুনিয়রদের কেউ এমপিও হয়েছেন। ইতি টানি বিখ্যাত সেই গানের লাইন দিয়ে– জীবনে যারে কভু দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল?… কানাইঘাটে জন্ম নেওয়া বিরল প্রতিভার অধিকারী খ্যাতিমান ইসলামিক স্কলার আবু সাঈদ চৌধুরীকে জীবদ্দশায় মূল্যায়ন করা দরকার।