১৬ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সকাল ১০:১৪
সংবাদ শিরোনাম

আবদুল কাদির জীবন-এর “দুঃখ নাচে সুখের কাছে” ; স্বপ্ন ও ভালোবাসায় জীবনের উন্মেষ

বাশিরুল আমিন
  • আপডেট বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ৯৮ বার পঠিত


একখানা বই নিয়ে হরেক রকমের আলাপ তোলা যায়। ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে বইকে বিচার করা যায় বা কখনো করতে হয়। এককজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে একেক রূপে ধরা দেয় বই। বলা চলে, বই হলো নারীমন, তাকে বুঝে ওঠা দুষ্কর। সময় সাপেক্ষ বটে। আরেকটু সাহস করে বলেই ফেলি, বই হলো প্রত্যুৎপন্নমতি এক সুন্দরী ললনা। সুতন্বী, সুহাসিনী আর লাবণ্যময়ী। কেউ তার রূপের প্রেমে পড়ে, কেউ বা তার হাসির আবার কেউ তার বিদ্যা-বুদ্ধির। ওমর খৈয়াম এমনি এমনি তোর বইকে অনন্ত যৌবনা বলেননি! আর বইটি যদি হয় কাব্যের তবে সে তো অনন্ত অষ্টাদশী।

ধরা যাক আব্দুল কাদির জীবনের কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখ নাচে সুখের কাছে’ একজন সুদর্শনা রাজকুমারী। দেখা যাবে কেউ হয়তো শুধু বইয়ের প্রচ্ছদ আর সেটাপ-গেটাপ দেখেই প্রেমে পড়ে গেল। বাহ! কী দারুণ দেখতে। দুধে-আলতা প্রচ্ছদ। বাধাইটি কী আঁটোসাটো। কী স্লিম আর ফিটফাট! ছাপাটা দেখেছো যেন কাজল কালো। বেশ, কেউ তার চেহারা দেখেই পটে গেল। ভেতর নিয়ে আর তেমন ঘাটলো না। এটি অবশ্য লেখকের জন্য খুব একটা সুখকর নয়, এ প্রেম তো চিরস্থায়ী না। ক্ষণিকের।

আবার দেখা গেল কেউ এই বইয়ের মজার ছড়া বা কবিতা পড়ে খুব উতালা হয়ে উঠলো। আহা! কী আনন্দটাই না হচ্ছে বইটা পড়ে। দেখেছো বইটা কী মজার। যেন প্রতিটি হরফ থেকে মিহি-মিষ্টি হাসি ঝরে পড়ছে। এ পাঠক দুধের মাছির মতো স্বল্প কালের প্রেমে পড়লো, এ প্রেম সুসমেয়র। এটাও আব্দুল কাদির জীবনের বইয়ের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।

এবার বলি, শেষ দলের লোকজন নিয়ে। এরা একটা বই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়বে। সময় নিয়ে ভেতর বাহির সবটাই দেখবে, রূপ-গুণ, বিদ্যা-বুদ্ধি সব দেখেশুনে প্রেমে পড়বে। এবং একটা পর্যায়ে দেখা যাবে তারা এই বই বা প্রেমিকা নিয়ে বিছানায় যেতেও কুন্ঠাবোধ করছে না। পড়ার টেবিলে বসে তো পড়ছেই ঘুমানোর আগে বুকের উপর রেখেও চোখ বুলিয়ে নেয়। তার গভীরে যায়, উচ্চতায় ওঠে। তার ভেতরকার সুখ-দুঃখ, প্রেম-দ্রোহ, আবেগ-নিরাবেগ সব পাঠ করতে চায়। ধীর লয়ে তাকে বুঝে ওঠার চেষ্টা করে। এভাবে বইটি পাঠক মননে দীর্ঘমেয়াদি একটি আসন পেতে নেয়।

পাঠক হিসেবে আমি কাব্যগ্রন্থটির দীর্ঘস্থায়ী প্রেমে পড়ার চেষ্টা করেছি এবং পড়েছিও। কিন্তু পড়ার উপলব্ধিটা সেই অর্থে প্রকাশ করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। প্রেম বা ভালোবাসার অনুভূতির কতটুকুই বা শব্দ দিয়ে ব্যখ্যা করা যায়। তবু কিছু কথা বলবে, না বলেও তো পারা যায় না। বিশেষ করে এর ভেতরকার স্বপ্ন-আশা-দ্রোহ-প্রেম ও আধ্যাত্মবাধের বিষয়টি। দেশ ও মাটির টানও আমাকে আকর্ষণ করেছে যা তাকে কবিতায় অনন্য উচ্চতা দান করবে।

তার কবিতায় সমাজ, ধর্ম ও ভাষার বন্দনাও উল্লেখ্য। তবে দুঃখকে গভীর ও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছে জীবন। দুঃখ ও সুখকে সমান্তরালে এনে নিবিষ্ট বিচার-বিচেনায় ফেলে দেখেছে সে আর সেসব কথাই ছন্দে ছন্দে বলেছে। ফলে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে এক দার্শনিক অভিব্যাক্তি- ‘দুঃখ নাচে সুখের কাছে’।

যারা আব্দুল কাদির জীবনকে কিছুটা হলেও জানেন তাদের কাছে বিষয়টি একদমই খোলাসা যে, জীবন একজন দ্রোহী যুবক তার ভেতরের তারুণ্য তাকে দ্রোহী ও প্রতিবাদী হিসেবেই দাঁড় করাতে চায়। সমাজও সভ্যতায় ঢুকতে চাওয়া সকল অনাচার ও অবিচারকে রুখতে চায় জীবন। নতুন স্বপ্নে সাজাতে চায় সমাজ, জাতি ধর্ম। সাজাতে চায় নিজেকে। দেখুন এক স্বাপ্নিক যুবকের আশাবাদী উচ্চারণ-

স্বপ্নের মাঝে বেঁচে আছি
স্বপ্নতেই মরি
স্বপ্ন দেখি দুই চোখেতে
স্বপ্নতে কাজ করি।

(স্বপ্ন/ পৃ:২৫)
তার স্বপ্ন শিশুদেও নিয়ে, তার স্বপ্ন ভবিষ্যত নিয়ে। নতুন বছর নিয়েও আব্দুল কাদির জীবনের স্বপ্ন বেশ স্বচ্ছ ও সাবলীল। এ স্বপ্ন সবার। আপনার, আমার, সকলের। এ কথাগুলো তো আমাদেরই কথা-

নতুন বছর নতুন বছর
নতুন নতুন কাজ
নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর
নেই ভেদাভেদ আজ।
(নতুন বছর, পৃ:১১ )

কবি যখন স্বপ্ন দেখে তখন তার স্বপ্ন হয় সামগ্রিক। সকলের। এবং ভেদাভেদহীন। একজন কবির খেলাই স্বপ্ন আর আশা নিয়ে। সে সমাজ ও জাতিকে স্বপ্ন দেখাবে। স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন স্বপ্ন। যে স্বপ্ন অবাধ, যেখানে নেই কোন দ্বিধা-দ্বন্ধ ও স্বার্থপরতা। আব্দুল কাদির জীবন স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে সাফল্য দেখিয়েছেন।

কবি মাত্রই প্রেমিক। ভালোবাসার আরাধনায় মত্ত্ব সাধক। ভালোবাসা দিয়ে ভ্যূলোক জয় করতে চাওয়া এক নির্বিক যোদ্ধা। জীবনও এর ব্যতিক্রম নই। তার ভেতর আছে অফুরান ভালোবাসা, যা মানবিকতার গান গায়। যে ভালোবাসা সবার দুঃখে অশ্রু ঝরায় আবার সবার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়। যে ভালোবাসায় স্বর্গবাস হয়-

ভালোবাসা মানে হলো
স্বর্গে সুখের বাস
এই হৃদয়ে তাইতা করি
ভালোবাসার চাষ।
(ভালোবাস, পৃ:১২ )

তবে নয়নের প্রেম-ভালোবাসা শুধুই প্রাপ্তি আর প্রনোদনার কথা বলে না । তার ভোলোবাসা হলো অশ্রু আর চোখের ভাষায় তর্জমাকৃত এক গভীর জীবনবোধ। তা কখনো প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে সরব হয়, আবার কখনো বাবাকে উদ্দেশ্য করে। কখনোবা মায়ের চরণে উৎসর্গিত হয় সেই অপার্থিব ভালোবাসা। নবী প্রেম ও ¯্রষ্টার প্রেমেও মগ্ন হয় জীবনের কবিতা। মাগো আমার মা, বাবা, নবী ইত্যাদি সব কবিতায় জীবন আধ্যাত্মবাদ ও প্রেমকে অন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রশংসনীয় ব্যাপার।

প্রেম ও ভালোবাসার উপস্থাপনায় কবি প্রাজ্ঞতা দেখিয়েছেন ভাষা ও ছন্দের ভিন্নমাত্রিক ব্যবহারে। মনে হয়েছে নতুন কন্ঠে কিছু বলতে চেয়েছেÑ নতুন কায়দা-কানুনে। তার প্রেমে স্বপ্ন ও আশা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে। যেমন-

দুচোখ ভরা স্বপ্ন আমার
দুচোখ ভরা আশা
এই দুচোখে ভাসছে আমার
তোমার চোখের ভাষা।
(দুই নয়নের অশ্রু, পৃ:৪০ )

“কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে/ কবিতা এমন এক পিতৃঘাতী শব্দের শরীর” এরকম বলেছিলেন হেলাল হাফিজ। কবিতা এমনই কবির ব্যাক্তিগত জীবন কেয়ে ফেলতে চায়। দুঃখকে উগড়ে দিতে চায়, দুঃখবাদী করে তোলে কবিকে। কবি যেন দুঃখকে মৈথুন করে বেড়ান জীবনভর। আব্দুর কাদির জীবনকেও একজন সাচ্চা কবির মতো দুঃখবাদী মনে হয়। কষ্ট, দুঃখ নাচে সুখের কাছে, দুই নয়নের অশ্রু ঝরে কবিতাসমূহ তার কষ্টকে চিত্রায়িত করে ছান্দসিক জবানে। যেমন-

দুঃখ দিয়ে জীবন গড়া
দুঃখে ভরা মন
দুঃখ এবং কষ্টে আমার
কাটে সারাক্ষণ।
(দুঃখ নাচে সুখের কাছে, পৃ:৩৭)

নিজের ধর্ম, আচার-কৃষ্টি নিয়ে দ্বিধা ও সংকোচ কাটিয়ে ছড়া ও কবিতা লিখেছে জীবন। তার নিজের চিন্তা ও চেতনার কথা বলতে কুন্ঠাবোধ করেনি সে। কবিতা লিখেছে কোরআন নিয়ে, লিখেছে মসজিদ নিয়ে। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেতেও কার্পণ্য করেনি, কালের মহানায়ককে নিয়ে রচনা করেছে দারুণ সব পঙক্তি। কবি নজরুলের কথা বলেছেন শ্রদ্ধাভরে। ভাষা শহীদদের নিয়েও ছড়া লিখেছে জীবন-

ভাষার লাগি জীবন দিলো
সালাম রফিক ভাই
রাখবো ধরে তাঁদের স্মৃতি
বুকে দিলাম ঠাঁই।
(ভাষার জন্যে, পৃ:৩৫)

আখেরে স্বীকার করতে হয়, আব্দুল কাদির জীবনের উন্মেষ আশা জাগানিয়া। তার চিন্তার কাঁচামাল আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার রসদ কবিতাকে সমৃদ্ধ করবে। স্বপ্ন আর ভালোবাসায় জেগে উঠুক কবিতার নতুন এক প্রাণ। দুঃখকে বদলে ফেলো বন্ধু দ্রোহে, কষ্টকে বদলে ফেলো কবিতায়। নির্মলেন্দু গুণের স্বরে বলো-
দুঃখ কোরো না, বাঁচো।

লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র ও ইংরেজী সাহিত্যের ম্যাগাজিন দ্য আর্থ অব অট্রোগ্রাফ সম্পাদক আব্দুল কাদির জীবন রচিত “দুঃখ নাচে সুখের কাছে” কাব্যগন্থ্যটি সিলেটের পাপড়ি প্রকাশনি থেকে অমর একুশে বই মেলা ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। ঝকঝকে ছাপা আর ৪৮পৃষ্ঠার বইটি প্রচ্ছদ করেছেন রবিন ফয়ছল এবং বইটির মূল্য ১৩০/- টাকা। বইটি পওিয়া যাচ্ছে জসিম বক হাউজ, আম্বর খানা ও মারুফ লাইব্রেরী, জিন্দাবাজার, সিলেট। এ ছাড়া বইটি জনপ্রিয় অনলাইন রকমারী ডট কম এ পাওয়া যাচ্ছে।

লেখক: বাশিরুল আমিন, কবি

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2025 AkashBangla. Developed by PAPRHIHOST
Theme Dwonload From Ashraftech.Com
ThemesBazar-Jowfhowo