সিলেট বিভাগের ৫ ক্যাটাগরীতে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ ৫ জন অদ্যম নারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সিলেট আয়োজিত সিলেটে বিভাগীয় পর্যায়ে ‘অদম্য নারী পুরস্কার-২০২৪’ এর সম্মানানা প্রদান অনুষ্ঠান গত ২০ ফেব্রæয়ারি বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর পূর্ব শাহী ঈদগাহস্থ জেলা শিল্পকল্পা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ঢাকার মহাপরিচালক (গ্রেড-১) কেয়া খান ও অনুষ্ঠানের সভাপতি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মোঃ রেজা-উন-নবী সিলেট বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী যথাক্রমে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী সিলেটের আম্বিয়া খাতুন, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী সিলেটে হালিমা বেগম, সফল জননী সুনামগঞ্জের মাজেদা আক্তার, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুন জীবন শুরু করেছেন যে নারী সুনামগঞ্জের মোছাঃ রেহেনা বেগম, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী সিলেট নগরীর শেখ রওশন আরা নিপা-কে সম্মাননা ক্রেস্ট, চেক ও সনদপত্র প্রদান করেন।
বিভাগীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাগরীতে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী আম্বিয়া খাতুন ১৯৮৫ সালে সিলেট নগরীর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। নবম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন তার বিয়ে হয় নগরীর চারাদিঘিরপাড়, ৪-আলআমানী এর বাসিন্দা আসাদ আলীর সাথে, যিনি ছিলেন একজন মুদির দোকানী। আম্বিয়া বেগমের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। সে জন্য তিনি সেলাইয়ের কাজ, বøকবাটিক, বুটিক ও এমব্রয়ডরির কাজ শিখে ছিলেন। কিন্তু বিয়ে তার স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়। যৌথ পরিবারে বড় বউ তিনি, পরিবারের বড় ছেলে হওয়াতে সংসারের সকল দায়িত্ব ছিল তার স্বামীর উপর। সে দায়িত্ব পালন করতে করতে একসময় তিনি ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন। শত ক্লান্তি যেন তাদের ভালোবাসায় ফাটল না ধরাতে পারে সেই দিকে ছিল আম্বিয়া খাতুনের সকল প্রচেষ্টা।
২০০১ সালে তিনি যখন প্রথম সন্তান সম্ভবা হন তখন তার স্বামীর ব্যবসা ভালো চলছিল না। সংসারের অন্ন জোগাড় করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। আম্বিয়া বেগম স্বামীর পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে একটি সেলাই মেশিন ধার আনেন, শর্তে ছিল বিনিময়ে তিনি যখন যা কাজ করে দিতে বলবেন তা করে দিতে হবে এবং যখন মেশিন ফেরত চাইবেন তখন ফেরত দিতে হবে। আম্বিয়া খাতুন সকল শর্ত মেনে মেশিনটি আনলেন। সেলাই কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করতে লাগলেন, তা দিয়ে তার স্বামীর সাথে নিজেও সংসারের হাল ধরা শুরু করেন। কিন্তু ৫/৬ মাস যেতে না যেতেই তার আত্মীয় সেলাই মেশিনটি ফেরত নিয়ে যান। আম্বিয়া খাতুন কী করবেন ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। তিনি মেশিনটি পাওয়ার পর একটি দোকানের কারিগরি মজুরীতে সেলাই কাজ করতেন। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অবশেষে তিনি দোকানীকে বিষয়টি জানালে তিনি তাকে ৫ হাজার টাকা ধার দেয়। ঐ টাকা দিয়ে আম্বিয়া খাতুন একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে পূণরায় কাজ শুরু করেন।
সেলইয়ের আয় থেকে ধার করা ৫ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর কিছু সঞ্চয়ও করা শুরু করেছিলেন। তার সঞ্চয়, স্বামীর দোকানের আয় এবং নিজের বিয়ের স্বর্ণের গহনা প্রায় ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে নিজ বাসায় বুটিকের কাজ শুরু করেন। ঢাকা থেকে সস্তায় কাপড় এনে নিজে কাজ করতেন। বুটিকের কাজ তার অনেকের পছন্দ ছিল। পরবর্তীতে তিনি এর পাশাপাশি আরশি বুটিক হাউজে রেখেও কাপড় বিক্রি করতেন। বিক্রি হলে তারা তার টাকা দিয়ে দিত। এইভাবে তার বুটিক ও সেলাইয়ের কাজ এক সাথে চলতে থাকে। বুটিকের বিক্রি ভাল হওয়ায় আড়শি বুটিকে হাউজের প্রোপ্রাইটার নিজে জামিনদার হয়ে পূবালী ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা লোন নিয়ে দেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি ২০০৫ সালে নগরীর জেল রোডে একটি ছোট দোকান দেন। সেই থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে আরেকটি সেলাইয়ের দোকান নেন, যা এখনো বর্তমানে আছে। বর্তমানে তার ১টি সেলাই কারখানা রয়েছে যেখানে ২০টি সেলাই মেশিন রয়েছে, মাস্টার টেইলারসহ মোট ২২জন কর্মচারী তার প্রতিষ্ঠানে কাজ কারছেন। জেল রোডস্থ জিহা ফ্যাশন এন্ড টেইলার্স নামে ১টি বুটিকের দোকান রয়েছে যেখানে ৮ জন কর্মচারী কাজ করেছে।
আম্বিয়া খাতুন কঠোর পরিশ্রম করে অর্থনৈতিক ভাবে সফল হয়ে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় তাকে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী।
বিভাগীয় পর্যায়ে শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী হালিমা বেগম। নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দেবো।’ একজন শিক্ষিত নারী একটি পরিবারকে শিক্ষিত করে তুলতে পারেন। গড়তে পারেন একটি শিক্ষিত সমাজ।
এই সত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সিলেটের হালিমা বেগম ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ কানাইঘাট উপজেলার অন্তর্গত দর্পনগর পূর্ব গ্রাম জন্মগ্রহণ করেন। তার ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। মেয়ে সন্তান্ত হওয়ার কারণে শত বাঁধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে হালিমা বেগম এস.এস.সি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ভাল রেজাল্ট করায় উচ্চ শিক্ষার জন্য ভালো কলেজে ভর্তি হতে মন:স্থির করেন। তৎকালীন সময়ে কানাইঘাট উপজেলায় সরকারি / বেসরকারি কোন কলেজ ছিলোনা। তাই তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ২য় বিভাগে এইচ.এস.সি পাশ করেন এবং সিলেট এম.সি কলেজে গণিতে নিয়ে অনার্সে ভর্তি হন। এমসি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৯৯৯ সালে চাকুরীতে যোগদান করেন। অনার্স পড়া তার না হলেও পরবর্তীতে তিনি প্রাইভেটে সফলতার সাথে বিএসএস, এমএসএস পাস করেন। তিনি বি-এড, সি-ইন-এড, সম্পন্ন করেন। তখন কানাইঘাট উপজেলায় কোন মহিলা প্রধান শিক্ষক ছিল না। তার প্রমোশনের সুযোগ আসলে তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেন।
কানাইঘাট উপজেলার ১ম মহিলা প্রধান শিক্ষক হিসেবে হালিমা বেগম যোগদান করেন রায়গড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানে শিক্ষার কোনো পরিবেশই ছিল না। ক্লাসে ছাত্রছাত্রী খুব কমই উপস্থিত হত। অভিভাবকদের চিঠি দিয়ে, পায়ে হেটে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেন। এতে অভিভাবকদের বেশ সাড়া পান এবং শিক্ষার একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এ বিদ্যালয়টি ‘ডি’ ক্যাটাগরী থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরীতে উন্নিত হয়।
হালিমা বেগম উপজেলা পর্যায়ে ১০ বার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি বায়মপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দক্ষতা ও সফলতার সাথে কর্মরত আছেন। তার বিদ্যালয়টি উপজেলা পর্যায়ে ২০২২ ও ২০২৪ সালে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়। তিনি কানাইঘাট উপজেলার বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বলে উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সকলেই তাকে এক নামে চিনে।
হালিমা বেগম পল্লী গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তখনকার সময়ে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে থেমে না গিয়ে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় আজ তিনি শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী।
বিভাগীয় পর্যায়ে সফল জননীর কৃতিত্ব অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী মাজেদা বেগম। প্রবাদ আছে, একজন পুরুষ যখন শিক্ষিত হয় তখন সে নিজে শুধু শিক্ষিত হয়। কিন্তু একজন নারী যখন শিক্ষিত হয় তখন পুরো পরিবারই শিক্ষিত হয়। এমন একজন সফল জননী মাজেদা আক্তার জন্ম ১৯৫২ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার জল-জলা এবং হাওর বেষ্টিত ছোট্ট গ্রাম দৌলতপুরে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। হাওর বেষ্টিত গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে যৌথ পরিবারের ঘর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। গ্রামের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা যখন গৃহস্থালি-কৃষিকাজে সাহায্য করতো তখন তিনি তার সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়েছেন। সন্তানদের নীতি-নৈতিকতা, সততা, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, দায়িত্বশীলতা বিষয়ে সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছেন আপোষহীনভাবে। লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে নিজের স্বর্ণালংকার, জমিজমা বিসর্জন দিয়েছেন। আর এই কষ্টের প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। কষ্টের দিন শেষে দেখতে পেয়েছেন আলোর মুখ।
তাঁর ছেলেদের মধ্যে একজন সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম, আরেকজন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে গণপূর্ত অধিদপ্তরে কর্মরত, তৃতীয় ছেলে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কনসালটেন্ট। ছোট সন্তান আইনজীবী।
মাজেদা আক্তার একজন অনুকরণীয় অদম্য সাহসী জননী। সামাজিক প্রতিক‚লতা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা আর কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠায় আজ তিনি বিজয়ী মা।
জীবন সংগ্রাম শেষে তিনি একজন সফল মা হতে পেরেছেন। জীবনের সব শখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করায় মাজেদা বেগম সফল জননী শ্রেষ্ঠ অদম্য নারীর সম্মননা লাভ করেছেন।
বিভাগীয় পর্যায়ে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করেছেন যিনি মোছাঃ রেহেনা বেগম : জীবনে চলার পথ কখনো কন্টকহীন থাকে না, বিশেষ করে নারীদের জীবন তো নয়ই। তারপরও তারা জীবনের কন্টকময় পথ অতিক্রম করে নিজে স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের অগ্রপথিক হয়ে পথ দেখান এমনই এক নারী মোছাঃ রেহেনা বেগম ১৯৮০ সালে সুনামগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। দিনমজুর পিতার দশ সদস্যের পরিবারে অভাব অনটনের মধ্যে বড় হতে থাকেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। অভাবের কারণে মাত্র সতেরো বছর বয়সে দিনমজুরের সাথে তার বিয়ে হয়। সেখানেও তিনি শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। যৌতুকের জন্য তার উপর নির্যাতন চলতে থাকে। তারপরও তিনি দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেন।
২০১০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে মানুষের নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। তাই তিনি বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। বাবার বাড়ি এসে হাঁস-মুরগী পালন করতে শুরু করেন। এরপর তিনি ছাগল লালন পালন করতে থাকেন। এই আয় থেকে তিনি গরু পালনে উৎসাহী হন। ধীরে ধীরে তার আয় বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে তিনি ২৬ সদস্যের একটি স্বাবলম্বী দল পরিচালনা করছেন। নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে এখন লড়াই করে চলেছেন। ফসলি জমির পাশাপাশি তিনি নিজের জন্য ঘর তৈরি করেছেন। তিনি তার জীবনের নির্যাতনের বিভীষিকার স্মৃতি মুছে সমাজে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। তিনি চান তার মতো মেয়েরা নির্যাতিত হয়ে যেন ঘরে বসে না থাকে, নিজেরা যেন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
সকল সমস্যাকে পিছনে ফেলে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া শিখেছেন। স্বামীকে ছাড়া সন্তানদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন। রেহেনা বেগম ভাবেন তিনি নারী, তিনি সাহসী, তিনি অপরাজিতা। তাই তিনি শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী পুরস্কার লাভ করেছেন।
বিভাগীয় পর্যায়ে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী : শেখ রওশন আরা নীপা। সিলেট সদর উপজেলা নিবাসী শেখ রওশন আরা নীপার মা-বাবা যুক্তরাজ্য প্রবাসী হওয়ায় ১৯৭৪ তার জন্ম হয় লন্ডনে। তার বয়স যখন ১১/১২ তখন তিনি লন্ডন থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজের উন্নয়নে কাজ করেছেন। তার টিফিনের টাকা থেকে অসহায় গরীব ছাত্র ছাত্রীদের নাস্তা কিনে দিয়েছেন। তিনি টিউশনি করে সেই টাকা দিয়ে গরিবদের সাহায্য করেছেন। তাছাড়া তার জমানো সঞ্চয়ের টাকা থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি লেখাপড়া শেষ করে বিয়ের পর পুনরায় লন্ডন চলে যান। লন্ডনে গিয়েও নীপা বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে যোগ দেন এবং উন্নয়ন মূলক কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন এওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি লন্ডনে থাকলেও দেশের জন্য তার খুব টান ছিল।
শেখ রওশন আরা নীপা ইচ্ছা ছিল দেশের জন্য কিছু করবেন। তাই তার এলাকার অসহায় গরীব মানুষের কথা চিন্তা করে প্রায় ২২ বছর আগে ২০০০ সালে ২৩ ডিসেম্বর তার নিজ হাতে গড়ে তুলেন সিলেটের বালুচর এলাকায় তরুছায়া মহিলা সংস্থা নামে একটি সংগঠন। এই সংস্থাটি এখনো চলমান রয়েছে। এই সংস্থার মাধ্যমে তার নিজস্ব তহবিল থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রতি বছরই বাংলাদেশে আসেন এবং সমাজের অবহেলিত নারী ও শিশুদের উন্নয়নে কাজ করেন।
শেখ রওশন আরা নীপা’র ব্যক্তিগত তহবিল থেকে নিঃস্বার্থভাবে সমাজের তথা দেশের উন্নয়নে যে সকল কাজ করছেন তাহলো ৩টি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ১টি বয়স্কদের স্বাক্ষরতা কার্যক্রম ও ১টি বøক-বাটিক, নকশী কাঁথা, চটের ব্যাগ তৈরী এবং ক্রিস্টাল সোপিস তৈরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার অসহায় নারীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রায় ৮ হাজার সেলাই মেশিন প্রদান ও ৩ শতজন নারী উদ্যোক্তা তৈরী করেছেন। ব্যবসা স¤প্রসারণের জন্য তাদেরকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করেছেন। প্রতিবন্ধি নারী পুরুষের মধ্যে প্রায় ৩ শত হুইল চেয়ার বিতরণ করেছেন নীপা। গরিব অসহায় মানুষদের চিকিৎসার জন্য প্রায় ১০ দশ লক্ষ টাকা বিতরণ ও ৬ শতজন বয়স্ক নারী পুরুষ কে স্বাক্ষর শিখানো হয়েছে। এই সকল উন্নয়ন কার্যক্রম শেখ রওশন আরা নীপা নিজস্ব অর্থায়নে জনস্বার্থে সম্পাদন করেছেন। তার এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৩ সন্তানের জননী। সন্তানেরা সকলেই ইংল্যন্ড থাকেন। তিনি জানান তরুছায়া মহিলা সংস্থাটি সকলের সহযোগিতা পেলে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাবে।
উপরোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ শেখ রওশন আরা নীপা শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী সম্মাননা লাভ করেছেন।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক শাহিনা আক্তার বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে তৃণমূলের সংগ্রামী নারীদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর জীবনযুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অদম্য নারী অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রমের ধরাবাহিকতায় সিলেটে বিভাগীয় পর্যায়ে নির্বাচিত ৫ জন শ্রেষ্ঠ অদম্য নারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। আগামীতেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী সম্মাননা প্রদান অব্যাহত থাকবে।