আবদুল কাদির জীবন : মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুটি। একটি হল- ঈদ-উল-ফিতর এবং অপরটি হল- ঈদ-উল-আদহা। একমাস সিয়াম সাধনার পরে আসে ঈদুল ফিতর। মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় রোযা ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে সব ভেদাভেদ ভুলে ভালোবাসায় আবদ্ধ হওয়া, একসাথে পথচলা। মনের সব কালিমা দূর করে সুন্দর জীবনের জন্য শপথ গ্রহণ করা। ঈদগাহে সব পেশার মানুষ এক সারিতে নামায আদায় করার দৃশ্য কতই না সুন্দর। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিখ্যাত গান, ‘ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। সন্ধ্যার আকাশে ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের ঘরে ঘরে বাজতে শুরু করে। চারদিকে ঈদের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদের মাইকে শোনা যায় রাত পোহালেই ঈদ। দেশবিদেশে সবার মুখে একই সুর। একাল সেকালের ঈদের আনন্দ এক নয়।আগেকার মানুষের ঈদ আর আধুনিক বিশ্ব বা এই প্রজন্মের মানুষের ঈদ অনেক তফাৎ। বয়স ভেদে যেমন ঈদের পার্থক্য লক্ষ করা যায় ঠিক তেমনি সময়ের সাথে সাথে যে ঈদের আনন্দ ও অনুভূতিও ভিন্নতা রয়েছে তা স্পষ্ট।
ঈদ মানে খুশি। সেই খুশিতে সবাই শরিক হয়ে জীবনের স্বাদ আর অনাবিল আনন্দ লাভ করত সাধারণ জনগণ। আনন্দ করার এ সংস্কৃতি কালের প্রবাহে আজ নতুন রূপে রূপায়িত হয়েছে। ঈদের দিনে সেকালে ভোরেই পুকুরে ডুব দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়ে আগে গোসল করা হতো। বয়স্করা বাড়িতে সুগন্ধী সাবান মাখিয়ে কুয়োর পানিতে গোসল করতেন এবং তা করতেন খুব সকালবেলা। ঘরের কাজ-কর্ম শেষ করে মহিলারা দ্রুত গোসল সেরে নিতেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাত ধরে বা বয়স্কদের সঙ্গে নতুন কাপড় ও সুগন্ধি বা আতর মেখে ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া ছিল সেকালের রেওয়াজ। নতুন কাপড় ঈদের দিন সকালে পড়া হতো এর আগ পর্যন্ত কাউকে দেখানো হতো না। নতুন কাপড় ঈদের আগে অন্য কেউ দেখলে ঈদ নাকি ছলে যায়। যার জন্য শিশুরা অনেক কান্নাকাটি করতো।
আমরা আজ জানবো বিশিষ্টজনের চোখে একাল-সেকাল ঈদের অনুভূতি:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. হাবিবা খাতুনের ভাষায়, আগেকার ঈদ উৎসবের আয়োজন স্মৃতিমধুর। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এর আয়োজন চলত মাস ধরে। বাড়িঘর ধোয়া-মোছা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, ভালো খাবারের আয়োজন করা, নতুন পোশাক কেনা এবং পরিধান করা ইত্যাদি এ ঈদ উৎসবের অংশ। চালের গুঁড়া দিয়ে ফুল পিঠা তৈরি করা হতো, পাড়ার সমমনা মহিলাদের উদ্যোগে আয়োজন করা হতো, পাড়া প্রতিবেশীদের প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে, দিনের কিছুটা সময় বেছে নিয়ে, বসার পিঁড়ি জোগাড় করে সবাই একত্রে বসে পিঠা তৈরি করে সেগুলোতে যার যার পছন্দমতো নকশা করত। খেজুরের কাঁটা ব্যবহার করে এ নকশা করা হতো। অপরূপ নকশা ফুটে উঠত প্রত্যেকটি পিঠায়। যে যত তাড়াতাড়ি পিঠা তৈরি শেষ করতে পারত, তার কৃতিত্ব ছিল বেশি। সে বেশি প্রশংসিত হতো। এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে পান-সুপারি খাওয়া হতো। তখন এক আনন্দমুখর পরিবেশ বিরাজ করত। প্রত্যেকটি পিঠাকে সর্ষের তেলে ভেজে দীর্ঘদিন ধরে মাটির হাঁড়িতে রেখে দেওয়া যেত। অবশেষে খাবার হিসেবে এ পিঠা পরিবেশনের জন্য আবার তেলে ভেজে গুড় বা চিনির শিরায় ভিজিয়ে রেখে খাওয়া হতো। এ এক মহাযজ্ঞ বলে বিবেচিত হতো। অনুরূপভাবে একটি টিনের টুকবার মাঝে সারি সারি লাইনে তারকাটার সাহায্যে ছিদ্র করা হতো। চালোনের চারদিকে বাঁশের চটি দিয়ে ফ্রেমে বেঁধে হাতে ধরার ব্যবস্থা করা হতো। দুজন মহিলা এই চালোনের ওপরে সিদ্ধ চালের নরম ভাতের গোলা রেখে, হাতে ডলে বা চাপ দিয়ে ঝুড়ি পিঠা বানাত। দুপুরের রোদে পাটি বিছিয়ে ঝুড়ি পিঠা শুকানোর নিয়ম ছিল। আবার কাঠফাটা রোদে টিনের চালের ওপরেও এসব পিঠা ঝরঝরে করে শুকানো যেত। মাটির হাঁড়িতে এ পিঠা রাখার নিয়ম প্রচলিত ছিল। পরিবেশনের আগে বা ঈদের দিনে গুড়ের শিরায় ঝুড়িপিঠা খেতে খুব মজা হতো। এ রীতি আজও গ্রামগঞ্জে আছে বলে মনে হয় ।
প্রফেসর ড. গাজী আবদুল্লাহেল বাকী বলেন, আমার বর্তমান বয়স ৭৪। আমি যখন প্রাইমারী এবং হাইস্কুলে পড়তাম, তখন ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করতাম। নামাজের পর দেখতে পেতাম মানুষে মানুষে কোলাকুলি করতেন। সেই সাথে ছোটরা বয়ষ্কদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতো। কোন সময়ে দুই জন বা দুই দলের মধ্যে বিগত দিনে ঝগড়া-বিবাদ থাকলে তারা ইমাম সাহেবের নিকট আসতেন ও হাতে হাত মিলিয়ে ও কোলাকুলির মাধ্যমে তিনি তা মিটিয়ে দিতেন। লিবিয়ায় থাকাকালিন সময়ে তথায় আমি দুইবার ঈদ উৎযাপন করি। জায়নামাজ ব্যতীত বালুর মাঠে সকলের সাথে নামাজ আদায় করি। তারা কোলাকুলি করতেন ও অনেকে ঘাড়ে ঘাড়ে চুমা দিতেন। বর্তমানে শহরে নামাজ শেষ হলে ঈদের মাঠটি প্রাণহীন মনে হয়। মাওলানা সহেবরা কোলাকুলির বিরুদ্ধে এটা ‘বিদআত’ বলে ফতোয়া দেন। ফলে কেহ কোল্কাুলি করেন না। এব ফলে হৃদয়ে হৃদয়ের মিল ও এক টুকরো ঈদ আনন্দ মুহূর্তে হারিয়ে যায়।
আকাশ বাংলা ডটকম-এর সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান এ এইচ মাহমুদ রাজা চৌধুরী বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মার একটি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। যাহা অপসংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলে ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধনে আবদ্ধ করে। অতীত যুগের ঈদুল ফিতর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপনের মেলবন্ধন হয়েছে বটে আধুনিক বিশ্বায়নে ঈদের আমেজ প্রযুক্তির কারণে গ্রাম থেকে শুরু করে বিশ্বের আনাচে কানাচে সহজে পৌঁছে গেছে। যা অতীতে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম. সাইফুর রহমান তালুকদার বলেন, আমাদের ছেলেবেলার সময়ের ঈদের অনুভূতি বর্তমান সময়ের তুলনায় ছিল অন্যরকম। তখন ঈদের নতুন জামা-কাপড়ের দিকে আকর্ষণ থাকতো বেশি। নানারকম পিঠা-পায়েস ফিরনি ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় খাবার আমাদেরকে বেশি আকর্ষণ করত। ঈদের মাঠ থেকে বেরিয়ে শুরু হতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় এবং মিষ্টিভোজন। ঈদে কে কত সুন্দর কাপড় পেয়েছে এ নিয়ে থাকত অঘোষিত প্রতিযোগিতা। এছাড়া ঈদের দিনে খুব ভোরে বাড়ির সান-বাঁধানো দিঘিরঘাটে আমরা দলবেঁধে গোসল করতে যেতাম। সবাই একসাথে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে হৈ-চৈ করে গোসল করতাম। ঐ গোসলের আনন্দ অন্য সময়ে পেতাম না। ঈদের সকালে নতুন জামাকাপড় পরে যে বেরুতাম -সন্ধ্যা পর্যন্ত সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মাঠে মাঠে ছুটাছুটি করেই পার করতাম, খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলেই যেতাম। ঈদগাহ মাঠে গিয়ে বাঁশি কিনতাম, নানারকম মিষ্টি কিনতাম, সবাই মিলে মজা করে বাঁশি বাজাতাম আর মন্ডা-মিঠাই খেতাম। শহরে আমরা পাশের বাড়ির মানুষের খোঁজ রাখি না, আর গ্রামে এর ভিন্নরূপ; পুরো গ্রামটাই নিজের মনে হয়, সবাই সবাইকে চেনে, সুখ-দুঃখের খবর রাখে। এখনো মনে পড়ে, ছোট বেলায় মা-বাবার কাছ থেকে একটা শার্ট বা গেঞ্জি পেলেই খুশির জোয়ারে ভাসতাম। বাবা আমাদেরকে খুব ভোরে নিয়ে যেতেন ঈদগাহ পরিষ্কার করতে। কিন্তু কালের বিবর্তনের ফলে ঈদের আমেজ এখন অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমাদের সন্তানরা আর সেই আমেজ পাচ্ছেনা। এখন সবকিছুই ভার্চুয়াল হয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ আমরা এখনো মাঝেমধ্যে বন্ধুদের আড্ডায় এখনো সেই ছেলেবেলায় ফিরে যাই। ঈদ আসলেই সেই সময়ের কথা মনে পড়ে। জীবনের সেই সোনালী শৈশব এখন অনেক মিস করি।
কবি ও সংগঠক মাসুদা সিদ্দিকা রুহী বলেন, ঈদ এলেই আমার অশোক বনে চাপা চঞ্চলতা। এই শহরের রৌদ্র ছায়ায় বেড়ে ওটার গল্পে একটা উনুন ছিলো, একটা হারিকেন ছিলো, জোনাকি পোকা ছিলো, চাঁদ রাতে মেহেদি পড়ার ধুম, পিঠা বানানোর তুমুল উত্তেজনা। আমাদের শৈশব কৈশোরের দিন এমনই ছিলো। আজ ভার্চুয়াল জগতের জীবন ধারায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মাধুর্য মন্ডিত সময় আমাদের নেই। মুঠোফোনে ঈদ শুভেচ্ছা, কোনরকম একটা কপি করা মেসেজ। যেখানে প্রাণের কোনো বারতা নেই। এ ঘরে ও ঘরে যাওয়া আর সালাম করে সালামি নেয়াও নেই। ছোট একটা পার্স থাকতো টাকা রাখার। সেই পার্স ব্যাগ কোথায় যে বিলীন হলো। আনন্দ পাওয়ার মনটাই নেই। আহা কি ফেলে এসেছি জীবনের গহীন মাঝে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবুজের গন্ধ মাখা সূর্যের হাসি কেমন ফ্যাকাসে মলিন। দলবেঁধে সিনেমা দেখার প্লান আর এখন নেই। অনেক আবেগ মুছিয়ে দিয়েছে প্রযুক্তির নির্ভরতায়।