‘ভ্রমণ আমাদের মনের জানালা খুলে দেয়।’ ভ্রমণ হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার নাম। নতুন স্থানের ঘ্রাণ নেয়া আর নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হওয়ার প্রধান মাধ্যমই হলো ভ্রমণ। কাজের চাপ বা মনে মধ্যে জমে থাকা স্ট্রেস বা চাপ আর উদ্বিগ্নতা কমাতে ভ্রমণই ঔষধ। ভ্রমণে নিজের মধ্যে শান্তি ও প্রশান্তি পাওয়া যায়, কমে যায় মানসিক চাপ। জীবনটা উপভোগ করতে হয় প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতি আনন্দে। যত বেশি হাসবে, যত কম অভিযোগ করবে, জীবনটা ততই ভরে উঠবে সুখে, পরিতৃপ্তিতে। জীবন মানে নিরন্তর ছুটে চলার নাম। পদে পদে বাধা-বিপত্তি আসবে, প্রতিক‚লতায় রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত হবে, সে ক্ষত মুছে আবার প্রবল আগ্রাসে ঝাঁপিয়ে পড়া আর সংগ্রাম এবং তারপর সাফল্যই হলো জীবন!
আমি মনে করি এবং বিশ্বাস করি ভ্রমণের মাধ্যমে একজন মানুষের চিন্তাভাবনার প্রসারণ ঘটে, সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটে তাছাড়া জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। এছাড়াও মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে আচরণ করতে হয়, কীভাবে একটি সমস্যাকে সুন্দরভাবে সমাধান করতে হয় এগুলিও ভ্রমণের মাধ্যমে শেখা যায়। তাই যখনই সুযোগ পাই তখনই প্রিয় জায়গায় ঘুরে আসি, খুব ভালো লাগা ফিল হয়। জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হয়!
প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড নামে পরিচিত শিলং। সবুজে ঘেরা পাহাড়, আকাবাঁকা উঁচু-নীচু পথ, টিলা আর টিলা, সারি সারি ঘাস-বন এবং ফুল ও ফল, উপরের দিকে তাকালে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে যেতে পারেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে সৌন্দর্যে। বাংলাদেশে যেমন ঝরনা খুঁজে বের করে দেখতে যেতে হয় মেঘালয়ে এর পুরোটাই বিপরীত। চলার পথে আপনার মনে হবে যেন ঝরনাই আপনাকে দেখতে এসেছে। ছোটো-বড়ো মিলিয়ে এখানে যে কত ঝরনা রয়েছে তার হিসাব হয়তো কারও জানা নেই। ঝকঝকে রোদ আর সবুজ ঘাস সেজে আছে মেঘালয়ের প্রকৃতির সৌন্দর্য। দেশের বাহিরে প্রথমবারের মতো বেড়াতে স¤প্রতি ঘুরে এলাম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং-এর অনেক জায়গা। সে অভিজ্ঞতা থেকেই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করব শিলং ভ্রমণের ৩ রাত ৪ দিনের পরিকল্পনা। আলহামদুলিল্লাহ ভালো সময় কেটেছে। চারদিনের ভ্রমণের সফর নিয়ে অগোছালো কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করতেই এই ব্যর্থ চেষ্টা।
১ম দিন : বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪ খ্রি.
বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ। সকাল ৯ ঘটিকার সময় সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্টের সেন্ট্রাল মার্কেটের সামন থেকে রিকশাযোগে ইবনে সিনা হসপিটালের পাশে জাফলং এর তামাবিল বর্ডারের বাসস্ট্যান্ডে গেটলক বাস দিয়ে তামাবিল এসে পৌঁছি বাংলাদেশ পুলিশ ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করে তারপর ইন্ডিয়ার ডাউকি পুলিশ ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে প্রধান ফটকে বাহির হলাম। এখানে অনেক অটোওয়ালা/কার কিন্তু যাত্রী কম। কারণ ৫ আগস্টের পর থেকে ভারত সরকার ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে বেশিক্ষণ অপেক্ষা বা লাইন বিড়ম্বনা বেশি পোহাতে হয়নি। অনেক দরকষাকষির পর একটা অটোও ঠিক করতে পারলাম না। পরে কার দিয়ে ডাউকি বাজার পর্যন্ত যাই পরে সেখানে হালকা নাশতা করে চার সিটওয়ালা একটা কার ২৩০০ রুপি দিয়ে রিজার্ভ করে পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের মেঘালয়ের রাজ্যের শিলং এর উদ্দেশ্য রওয়ানা।
সিলেট থেকে ডাউকি পর্যন্ত ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আমার সাথে আছেন, ছাতক উপজেলা অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি, দৈনিক আলোকিত সিলেটের স্টাফ রিপোর্টার, সাংবাদিক তানভীর আহমদ জাকির। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার পৌরসভার বাসিন্দা। ডাউকি থেকে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আরও দুজন ভ্রমণসঙ্গী। তার মধ্যে একজন হলেন শুভন চৌধুরী। তিনি হবিগঞ্জ পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ (ডিএসবি) এর অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর (এএসআই)। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার আশুগঞ্জ সদরের বাসিন্দা। অপরজন সফরসঙ্গী হলেন পাথর ব্যবসায়ী মো. শাহ আলম। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার পারুয়া এলাকার বাসিন্দা। তারপর শিলং-এ আমাদের সাথে পরিচয় হয় আরেকজন ভাইয়ের সাথে। তিনি হলেনÑশিহাব উদ্দিন, তিনি একজন ব্যবসায়ী, বাড়ি সিলেট জেলার জালালাবাদ থানার বাদাঘাট এর বাসিন্দা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের মাঝে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। চলা হয় চারদিন একসাথে। অনেক স্মৃতি হৃদয়ের পাতায় পাতায় অমলিন হয়ে যায়।
পুব আকাশের সূর্যের আলোকে গায়ে লাগিয়ে প্রাইভেট কার পর্যটন এরিয়া সাইট সিং করে করে শিলং পুলিশ বাজার সেন্টার পয়েন্টে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয় যায়। পথিমধ্যে আমাদের অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম মেমোরিয়াল ইকো পার্ক এবং আরও অনেক। তখন বেলা সন্ধ্যা নেমে আসে। নতুন অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে; তাই আমরাও খুব উৎফুল্ল এবং রোমাঞ্চিত। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার হোটেলের ম্যানেজারকে ফোন করে আমাদের জন্য একটা রুম ঠিক করে দিলেন। আমরা ২০০০ (দু- হাজর রুপি) দিয়ে চারজনের জন্য একটা রুম বরাদ্দ করলাম। হোটেলের নাম সিরিন। এটা শিলং পুলিশ বাজারের খুব পরিচিত হোটেল। তারপর ফ্রেশ হয়ে বাহিরে খাওয়ার জন্য বের হই। রাস্তার দু-পাশে হরেকরকমের দোকান; কাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রিট ফুড। এছাড়াও রয়েছে ব্যাগ এবং কসমেট্কিসের শপ। এখানে প্রচুর দামাদামি করে জিনিসপত্র কিনতে হয়। মুসলিম হোটেলে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। খাওয়া শেষ করে সোজা হোটেলে। গতরাত আমার সারারাত ভালো ঘুম হয়নি, তাই আমি বই পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
২য় দিন : বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪ খ্রি.
পরের দিন সকালবেলা উঠে ফ্রেশ হয়ে বাহিরে বের হই। আশপাশের বিভিন্ন জায়গা অ্যাক্সপ্লোর করার জন্য সিম কেনার চেষ্টা করেন শুভন ভাই কিন্তু ফরেনারের জন্য সিম কেনা বন্ধ ছিল। তাই আর কেনা হলো না। তারপর আমাদের চিন্তা নতুন রুম খুঁজতে হবে। কারণ প্রথম দিনের রুমটা আমরা একদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলাম। পরের দিনের জন্য ভাড়া অনেক বাড়িয়ে ২০০০ থেকে ৩০০০ হাজার রুপি দিতে বলে তাই আমরা নতুন রুম খুঁজতে থাকি। প্রথম রাতের হোটেলের চেক ইন হওয়ারও পরে শিলং এর বিখ্যাত মুসলিম হোটেল রয়্যালে ২৫০০ রুপি দিয়ে উঠি।
সকালে নাশতা করতে বের হলাম। এখান একটা কথা লক্ষণীয়, মনে রাখা ভালো, আমরা সবাই জানি ইন্ডিয়া হচ্ছে হিন্দু প্রধান একটি রাষ্ট্র। আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গো মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। এখানে প্রচুর গরু পালন করা হয় কিন্তু মাংস খাওয়া হয় খুবই কম। এতে করে সাপ্লাই বেশি হয় কিন্তু ডিমান্ড কম। আর আমরা জানি ইকোনমিক্স এর ভাষায়, সাপ্লাই বেশি হলে এবং ডিমান্ড কম থাকলে দামও কম হয়। আমরা যারা বাংলাদেশী আছি তারা অনেক টাকা খরচ করে গরুর মাংস খেয়ে অভ্যস্ত; বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম হচ্ছে ৭৫০ টাকা যেখানে ইন্ডিয়াতে ২৮৬ টাকা মাত্র! ৪৬৪ টাকাই কম! তাই সকালের নাশতা আটা দিয়ে তৈরি রুটির সাথে গরুর মাংস। দাম ১৬০ রুপি জনপ্রতি। নাশতা শেষ করে কিছুসময় শিলং বাজারের বিভিন্ন অলিগলিতে হাঁটাাঁটির পর দুপুর ১২টার দিকে আমরা ১০ জনি সিটের একটা কার ১৬০০ রুপি দিয়ে ভাড়া নিলাম। শিলং শহরের নজরকাড়া সৌন্দর্য উপভোগ করি তার মধ্যে ছিল ইডেন গার্ডেন, ইসপ্লানেড, পুরাতন আমলের ভবন, ওয়ান-ওয়ে রাস্তা। মাওলিননং ভিলেজ (এশিয়ার সবচেয়ে ‘পরিচ্ছন্নময়’ গ্রাম হিসাবে পরিচিত), উমিয়াম বারাপানি লেক (স্কটল্যান্ডের সমুদ্র শাখা বা হ্রদের সাথে তুলনাময়), অ্যালিফ্যান্ট জলপ্রপাত, শিলং পার্ক বা শিলং ভিউপয়েন্ট, গল্ফ লিঙ্ক (এটি ভারতের প্রথম ১৮টি গহŸর যুক্ত গল্ফ ক্ষেত্র) ওয়ার্ড’স লেক, লাইটলুম ক্যানিয়ন (খরমযঃষঁস মৎধহফ ঈধঘুড়হ), অল সেন্টস চার্চ, লেডি হায়দরি উদ্যান, পুলিশ বাজার (কেনাকাটার এই কেন্দ্রটি শিলং-এর বাণিজ্যিক কেন্দ্র), লেডি স্কট ট্রেইল, চেরাপুঞ্জি (বিশে^র সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া শহর বলে বিখ্যাত)। সব স্পট ভ্রমণ করতে বের হলেও সময় সীমাবদ্ধতার কারণে বেশকটিতে যাওয়া হয়নি।
যেহেতু বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি সেহেতু সেখানে গিয়ে মনে মনে খুঁজেছিলাম বিশ^বিদ্যালয়। অবশেষে খুঁজে পেলাম শিলং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ^বিদ্যালয়। তারপর কলেজ ও স্কুলের দিকে চোখ পড়ে। কী সুন্দর শত শত ছাত্রছাত্রীরা লাইন বেঁধে যাচ্ছে। সবাই যার যার গন্তব্যে ছুটছে। কেউ আসছে না-হয় কেউ যাচ্ছে। শিলং এর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে সেখানকার চমৎকার চমৎকার সব বিল্ডিং। বিল্ডিং এর গায়ে বাহারি রঙের আলো থাকায় এর সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। শিলং-এর পার্কের ভেতরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে সত্যিই অভিভ‚ত হই। খুব চমৎকার পরিবেশ; রাস্তার পাশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো, কেটারিং-এর শপ, বসার জন্য বেঞ্চ, ট্রলি, ছোটো কার, রেস্টুরেন্ট, ডাস্টবিন, এবং আরও অনেক কিছু। এত সুন্দর সাজানো গোছানো দেখে ভালোই লাগছে। রাতের খাবারের মেনু ছিল ভাত (আনলিমিটেড), গরুর মাংস (এক ভাটি), লঙ্কা, পেঁয়াজ, সবজি, এক বোতল পানি এবং সালাদ। রাতের খাবার শেষ করে রেস্ট নিচ্ছি। এভাবেই খুব ব্যস্ততার মধ্যেই সারাদিন অতিবাহিত হয়। ঘোরা, খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটা চলল রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত। সারাদিন জার্নির পর অনেক ক্লান্ত ছিলাম তাই এসেই ঘুমিয়ে পড়ি।
শিলং অঞ্চলটা আমার কাছে একটু বেশি সুন্দর মনে হয়েছে। আজও ব্রিটিশ আমলের কিছু ঘর-বাড়ি, দালান-কোটা সেই সাক্ষ্য বহন করছে। উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়। তার চ‚ঁড়াতে জমে আছে কত মেঘ। রং-বেরঙের ফুল-অর্কিড, গাছগাছালির সমাহার। পাহাড়ের বুক চিরে ঝরছে অজ¯্র ঝরনাধারা। পাদদেশে আঁকাবাঁকা সড়ক। এখানকার রাস্তা, বাড়িঘর, সরকারি ভবন সবকিছুই সাজানো, গোছানো সুন্দর। বিশেষ করে সরকারি ভবনগুলি স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য।
৩য় দিন : শুক্রবার ১৫ নভেম্বর ২০২৪ খ্রি.
পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তারপর জুম্মা নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিই। মুসলিম হোটেলে নাশতা শেষ করে মসজিদে নামাজ পড়ে ঘুরতে বেরিয়েছি শিলং এর বড়োবাজার। শুক্রবারে তাদের বড়োবাজার বন্ধ থাকে। সাথে সাথে আমরা চলে যাই বিশাল মার্কেটে। শুভন ভাই নিজের জন্য, বউয়ের জন্য এবং তাঁর মায়ের জন্য অনেক কেনাকাটা করলেন। আমি সাথে ছিলাম তাই দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিরক্তিবোধ করছিলাম। বিদায় নিয়ে রুমে চলে আসি। সত্যি বলতে কী, এখানে অনেক কিছুর দাম সস্তা। যেমন একজোড়া ফরমাল সু ৫০০ রুপি, সেইম সু বাংলাদেশের সিলেটে ৫০০০ হাজার টাকা। তাছাড়া শাহ আলম ভাই ও তানভীর ভাই কিনলেন চকলেট, সাবান, শাল, জ্যাকেট এবং আরও। আমি আমার মায়ের জন্য একটা শাল কিনেছি শুধু। যেহেতু আমরা আগামীকাল চলে যাব, তাই কেনাকাটার পর্ব এই রাতেই শেষ করে সবাই রুমে গিয়ে পৌঁছি। রাতে অনেক আড্ডা হয়েছে। অনেক মজা হয়েছে। নতুন কিছু জিনিস আমাকে স্পর্শ করেছে। এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। একটা বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলে দূর হয়ে যায়। আগামীকাল যাতায়াতের জন্য রাতেই ২০০০ রুপি দিয়ে কার ভাড়া করে রেখে দিলাম। যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসের ঝামেলা পোহাতে না-হয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চমৎকার একটা সিনারি উপভোগ করেছি; যেটা অন্তরের গহিনে দাগ কেটে গেছে, সারাজীবন অ¤øান হয়ে থাকবে। পুব আকাশের দিকে চাওয়ামাত্রই দেখি সূর্যের দৃষ্টিনন্দন রক্তিম আভা যা সাথে সাথেই মনকে পুলকিত করল; এই দৃশ্য কখনো ভোলার নয়। মনে মনে ভাবছিলাম আল্লাহ সোবাহানা তা’আলা কত সুন্দর করেই তার নিপুণ হাতের কারুকার্য দিয়ে এই জগৎটাকে সাজিয়েছেন! বিস্ময়ে অভি ভূত হলাম; তারপর কিছু ¯œ্যাপ নিলাম স্মৃতির পাতায় সংরক্ষণের উদ্দেশে। আস্তে আস্তে ধরণিতে দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ল। ফাইনালি জীবনের প্রথমবারের মতো দেশের বাহিরে ভ্রমণ আমার খুব ভালো লাগা ফিল হচ্ছিল।
ইউরোপের চেয়ে আমাকে অনেক বেশি টানে ভারতের ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। আর কত জনগোষ্ঠী। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ধারা। আমি মেঘালয়ের শিলং দেখলাম। রঙে-রূপে, গাম্ভীর্যে, সৌন্দর্যে প্রকৃতির এক অবাক করা সৃষ্টি এই শিলং। আমার বেড়ানোটা টার্গেট করে পয়েন্ট অনুসারে হয় না। আমি হাঁটতে পছন্দ করি। খুব বেশি হাঁটি। পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াই অনেকটা। আঞ্চলিক মানুষজনের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করি। কখনো বা গাড়িতে চলতে থাকি। হয়তো বেনামি কোনো জায়গা ভালো লেগে যেতে পারে। সেখানে কিছুসময় কাটানো মজাই আলাদা। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের সুন্দর সুন্দর চার্চ দেখা হলো এই প্রথম।
৪র্থ দিন : শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪ খ্রি.
আজকে আমাদের শেষদিন। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমাদের সবকিছু গোছগাছ করতে করতে প্রায় ৭:২০টা হয়ে যায়। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ভোরে উঠে রুমে এসে হাজির। ড্রাইভারের নাম ছিল কলিং। বয়স ৪৫। বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলতে পারে। আমি হিন্দি ভাষা ভালো বুঝি না, তাই ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে শুরু করলাম। বাস জার্নি সবাই করতে পারে না ঠিক তেমনি আমাদের সবার জানি বমি বমি ভাব করছিল। একজন ইতোমধ্যেই বমি করে দিয়েছেন এবং আরেকজন জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছেন যাতে কিছুটা হলেও সমস্যা দূর হয়। আমি আর শুভন ভাই ড্রাইভারের সাথে সারাক্ষণ কথা বলতে বলতে জার্নির আনন্দ উপভোগ করলাম। মধ্যখানে একটা ক্যাফের সামনে কার দাঁড় করিয়ে কিছুসময় রেস্ট নেয়ার চেষ্টা করি। ক্যাফেতে হরেকরকমের খাবার পাওয়া যায়; তার মধ্যে আছে পেটিস, সিংগাড়া, সমুচা, চা, কফি, মাসালা ভাটা, আরও নাম না-জানা বিভিন্ন ধরনের খাবার যেগুলি খেতে খুবই সুস্বাদু।
এদিকে আমি পাশের সাইড সিন দেখতে লাগলাম। প্রথমবারের মতো ভ‚মি থেকে এতটা উঁচুতে! খুব ভালো লাগা ফিল হচ্ছিল। যখন সর্বোচ্চ উচ্চতায় তখন আশপাশে শুধু সাদা মেঘ আর মেঘ, পাহাড় আর পাহাড়, কী সুন্দর গাছের সারি সারি লক্ষ করলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালা যেন নিজ হাত দিয়ে আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন। তখন আল্লাহ সোবাহানা তা’আলার বিশালতা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম।
ভারতের পাহাড় টিলা, ডাউকির উঁচু উঁচু পাহাড়, ডাউকি পাহাড়ের দুরন্ত ঝরনা, উঁচু পাহাড়ের গহিন অরণ্য সবকিছুই দেখতে পাবেন। দেশ ও বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে জনপ্রিয় এক পর্যটন ডাউকি অঞ্চল। এসব পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতুর সৌন্দর্যও মুগ্ধ করবে আপনাকে। একই সঙ্গে সীমান্ত ঘেঁষা ডাউকি নদীর স্বচ্ছ পানি দেখার লোভ সামলাতে পারেন না পর্যটকরা। মৌসুমী বায়ু প্রবাহের ফলে ভারত সীমান্তে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীর স্রোত বেড়ে যায়। তখন ডাউকি পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। ডাউকি নদীর পানির স্বচ্ছতাও জাফলংয়ের অন্যতম আকর্ষণ। ভারতের ডাউকি শহরের দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। ডাউকি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম জৈন্তিয়া পাহাড় জেলায় অবস্থিত একটি শহর। এই শহরটি এক বিশাল পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। খাড়া পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অসাধারণ সব বাড়ি তৈরি করে বসবাস করেন ডাউকিবাসীরা। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। রং-বেরঙের বহুতলা ভবন গড়ে উঠেছে বিশাল পাহাড়ের গায়ে। বাংলাদেশের জাফলং থেকে খুবই সুন্দর দেখায় ডাউকি পাহাড়শ্রেণি। একই সঙ্গে রাতে ডাউকি শহরের দৃশ্য এক অন্যরকম অনুভ‚তি দেবে আপনাকে। ভারতের ডাউকি অঞ্চলের পাহাড়, নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো।
আলহামদুলিল্লাহ। সময় সকাল ১১টা। আমরা এখন ডাউকি বর্ডারে ইন্ডিয়া পুলিশ ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে তারপর বাংলাদেশ পুলিশ ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করে সুস্থির নিশ্বাস মনের মধ্যে। দুপুর ১ টার দিকে তামাবিল বাসস্ট্যান্ডে সিএনজি ভাড়া করে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার প্রাকৃতিক গ্রামীণ পরিবেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চলে আসলাম আমাদের সেই চিরচেনা বাংলাদেশের সুপরিচিত আধ্যাতিক নগরী সিলেটের আম্বরখানা। এখান থেকে আমি আমার গন্তব্যের উদ্দেশে, শাহ আলম ভাই কোম্পানিগঞ্জ তার নিজ বাড়ির উদ্দেশে এবং শুভন ভাই ও তানভীর ভাই তাদের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেন। এভাবেই মানুষ মানুষের সাথে গভীর সম্পর্কের পরে একটা সময় হারিয়ে যায়!
লেখক:
আবদুল কাদির জীবন
নির্বাহী সম্পাদক, আকাশ বাংলা ডটকম