কবি, প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার আবদুল কাদির জীবন-এর গ্রন্থ
দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ : একটি বর্ণাঢ্য জীবনের মূল্যায়ন
মো. আব্দুল বাছিত
সমাজ, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি একটি জাতির মহত্তম গৌরবের বিষয়। এটি মহান সৃষ্টিকর্তার অপরিসীম করুণার অন্তর্গত একটি বিষয়। পৃথিবীতে মানবসভ্যতার যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, সেখানে পরিলক্ষিত হয়েছে দুটি শ্রেণি। একটি হচ্ছে মানবকল্যাণকামী এবং অপরটি হচ্ছে মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী। যদিও মধ্য প্রক্রিয়ার অর্থাৎ মাঝামাঝি শ্রেণিতে অবস্থান করেন এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরাজমান। দুটি প্রক্রিয়ার কোনোটিতেই নেই বলে আমি তাদেরকে বিবেচনা করি অস্তিত্বের শূন্যতা হিসেবে। এই বিচারে আলোচ্য থেকে যান উল্লেখিত দুটি শ্রেণি। প্রথম শ্রেণির হাত ধরে বিকশিত হয় সভ্যতা, লালিত হয় সংস্কৃতিবোধ এবং পরিমার্জিত হয় মূল্যবোধ ও ক্সনতিকতা। তাদের দ্বারা সমাজ হয় উপকৃত। কালে কালে তারা রেখে যান মহত্তম কর্মের সৌরভ। একটি নির্দিষ্ট যুগে জন্মগ্রহণ করলেও তারা থেকে যান অমর অক্ষয় হয়ে। অন্তত পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। কবির ভাষায় বলতে হয়Ñ‘আমি তোমারে দেবো না ভুলিতে’। অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিহাস এবং তার সর্বজনীন প্রক্রিয়া বেঁচে রাখে মহান মানুষদেরকে। অপরদিকে, কিছু কিছু মানুষ থেকে যান পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণিত ও নিন্দিত হয়ে। তাদের কৃতকর্মের জন্য পৃথিবী তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে না। বরং তাদের তিরোধান এবং অনুপস্থিতে পৃথিবীর মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে! মূলত মানবসমাজে তারা যে কর্ম রেখে যান, তা কেবই মানুষকে ধ্বংসের দিকে প্ররোচিত করে। বিধায়, প্ররোচিত মনও ধিক্কার জানায় এসবের ছলনায়।
উপমহাদেশের দানবীর মুহাম্মদ মহসিনের কথা আমরা সবাই জানি। দানবীর মুহম্মদ মহসিনের দান ও আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। শুধু তাই নয়, এ উপমহাদেশে দানবীর মুহম্মদ মহসিনের মহৎ কর্ম পুরো ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল। মুসলিম জীবনের পুনর্জাগরণে দানবীর মুহম্মদ মহসিনের সমাজ প্রাসঙ্গিকতা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। আমাদের ইতিহাসের গতিপথ এবং স্বাভাবিকতা নানা প্রান্তপথের জন্ম দেয়। এ পথ দিয়েই আগমন ঘটে অসংখ্য অগণিত মহান ব্যক্তিত্বের। উপমহাদেশের ভাঙন এবং বৃহত্তর পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজ্যতার কঠিন পরিস্থিতিতেও এ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন কিছু আলোকিত মনীষা। যারা তাদের চিন্তা-চেতনা এবং মৌলিক স্বকীয়তার দ্বারা মানবসমাজের উপকার করে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এসকল মানুষ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য গর্ব-অহংকারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক আমাদের সিলেট অঞ্চলেও জন্মগ্রহণ করেছেন অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী এবং কর্মবীর ব্যক্তিত্ব, যারা তাদের জ্ঞান-গবেষণা এবং মনীষার দ্বারা এ অঞ্চলের মানুষকেই শুধু নয়, বরং সমগ্র দেশ ও জাতিকে উপকৃত করে গেছেন। এ অঞ্চলে যেসকল মনীষার জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় একজন হলেন দানবীর রাগীব আলী। দানবীর রাগীব আলী কেবল শিল্পপতিই নন, বরং তিনি এ দেশের একটি আলোকিত ইতিহাস। একজন জীবন্ত কিংবদন্তি এবং মানবতার কল্যাণে নিবেদিত এক মহান কর্মবীর। অসামান্য পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন।
একজন সাধারণ চাকুরিজীবী হিসেবে প্রবাসজীবন যাপিত হলেও সময়ের ব্যবধানে তিনি হয়ে ওঠেন লক্ষ লক্ষ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। জীবন ও জীবিকার তাগিদ নিয়ে যে মানুষটি অস্তিত্বের সংকটসময় অতিক্রম করছিলেন, তিনিই এখন অসংখ্য অগণিত মানুষের আশার আলো। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ জীবনের গøানি দূরীকরণে সক্ষম হয়েছেন।
দানবীর রাগীব আলীর পরিচয় দেশ ও সমাজে স্বকীতায় বিধৃত। তিনি একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। এ অঞ্চলের সমাজসেবায় তিনি অতুলনীয় একজন ব্যক্তিত্ব। বলতে গেলে, সমাজসেবায় সমগ্র বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি কেবল সিলেটের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করেননি, বরং তিনি যেখানে বা যে অঞ্চলেই সুযোগ পেয়েছেন সমাজসেবায় অগ্রবর্তী হয়েছেন। তিনি সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মাদরাসা, মেডিকেল কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। অসংখ্য রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া শিক্ষা- স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সংবাদপত্র, প্রকাশনাসহ লেখক-গবেষকদেরকে নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে নিজস্ব সাহিত্য-সাংস্কৃতিক মননের পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া দারিদ্র বিমোচনেও তাঁর রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা। এ দেশের ব্যাংকিং খাতেও তাঁর বিনিয়োগ একটিউল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন এবং মানবকল্যাণে দানবীর রাগীব আলীর তুলনা
তিনি নিজেই।
আবদুল কাদির জীবন একজন প্রতিশ্শ্রুতিশীল কবি, প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার। তিনি একজন সম্পাদক ও দক্ষ সংগঠকও বটে। লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ডিগ্রি অর্জনকারী আবদুল কাদির জীবন সাহিত্য-সংস্কৃতির নানাবাঁকে নিজস্ব অবস্থান থেকে কাজ করে চলেছেন। সিলেট অঞ্চলে যেসকল তরুণ সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় নিবেদিত রয়েছেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। সম্পাদনা ছাড়াও তিনি মৌলিক গ্রন্থ রচনায় নিরলসভাবে কাজ করেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর একটি ছড়াগ্রন্থ ও একটি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘কবি কামাল আহমদ’র জীবন ও সাহিত্যকর্ম’ তাঁর সম্পাদনাগ্রন্থ। তিনি ইংরেজি লিটলম্যাগ ‘দি আর্থ অব অটোগ্রাফ’ সম্পাদনা করছেন নিয়মিত। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পর্যন্ত কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ‘কেমুসাস তরুণ সাহিত্য পুরস্কার (প্রবন্ধ)’ (২০২২) অন্যতম। আলোচ্য ‘দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ’ গ্রন্থটি তাঁর স্বরচিত প্রবন্ধ সংকলন। এ গ্রন্থে দানবীর আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি সংক্রান্ত লেখাগুলোই স্থান পেয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিত্ব ও সাক্ষাৎকার নামক আলাদা দুটি প্রবন্ধ তিনি এ গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন।
প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন ‘দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ’ গ্রন্থকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়েছেন। প্রথম অংশে তিনি ছয়টি প্রবন্ধকে স্থান দিয়েছেন। প্রবন্ধগুলো মূলত পাঁচটি ভিন্ন বিষয়ে রচিত। তবে এ প্রবন্ধগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম হচ্ছে ‘দানবীর ড. ক্সসয়দ রাগীব আলী : একটি ইতিহাস, একজন আলোকিত মানুষ’।
এ প্রবন্ধটির আলোচনা মূল ভূমিকায়ই করা হয়েছে। প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন অত্যন্ত সুন্দরভাবে একজন দানবীর রাগীব আলীর সমাজসেবা, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ নানামাত্রিক অবদানকে মূল্যায়িত করেছেন। তাঁর সংগ্রাম এবং বেড়ে ওঠা; সর্বোপরি দেশ ও সমাজের জন্য তার প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি সুবিবেচনায় এনেছেন। পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য তথ্যের সমাহারে তুলে এনেছেন দানবীর রাগীব আলীর জন্ম-বংশ পরিচয় এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা। এদিকটায়ও একজন রাগীব আলী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি কেবল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-ই করেননি, বরং শিক্ষার যে মাহাত্ম্য তিনি অন্তরে অনুভব করেছিলেন তার বাস্তব প্রতিফলনও তিনি তুলে ধরেছিলেন। বলতে গেলে বার্ধক্যের পরিণত জীবনে এসেও তিনি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে ‘টি ফর ফুড সিকিউরিটি’ বিষয়ের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। জ্ঞানার্জনে আগ্রহীদের জন্য এটা শিক্ষণীয় বিষয়ও বটে।
‘দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় প্রবন্ধ হচ্ছে ‘বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী : এক অসমাপ্ত প্রবাহিত নদী’। বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী কেবল দানবীর রাগীব আলীর সহধর্মিণীই ছিলেন না, বরং রাগীব আলীর জীবনসংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে এই মহিয়সীর নাম। একজন সাধারণ মানুষ থেকে দানবীর রাগীব আলীর যে বিশাল সামাজিক অবস্থান এবং মর্যাদা ক্সতরি হয়েছে, এর পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনিই হচ্ছেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। এ মহিয়সী নারী তার সারাটি জীবন স্বামীর সেবার পাশাপাশি সমব্যথী, সহযোগী এবং কল্যাণকামী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। সুখে-দুঃখে তাঁকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছেন। একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর সাহচর্য না পেলে একজন রাগীব আলীর এমন অবস্থান ক্সতরি হতো না। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজসেবা এবং মানবসেবায় আমৃত্যু প্রতিকৃৎ হয়ে ভূমিকা পালন করেছেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা ও দরদ। একজন মমতাময়ী স্ত্রী হিসেবে তিনি দানবীর আলীকে ভালোবাসা ও প্রেমের ডোরে বেঁধে রেখেছিলেন। তাঁদের পারস্পরিক মেলবন্ধনের প্রক্রিয়ায় যে নবজাগরণ ঘটে, সে কথার যথার্থতা খোঁজে পাওয়া যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়Ñ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। একথা অনস্বীকার্য সত্য যে, নারীরা প্রেরণা, ভালোবাসা ও সাহস জুগিয়েই অর্ধেক কাজ সমাধান করেছিলেন। প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন অত্যন্ত সুন্দরভাবে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর জীবনালেখ্য তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন একজন মহিয়সীর কথা। যিনি সারাটি জীবন স্বামীর মতো মানবসেবায় কাটিয়ে দিয়েছেন।
দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ গ্রন্থের তৃতীয় প্রবন্ধটি হচ্ছে লিডিং ইউনিভার্সিটিতে কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলা’ সংক্রান্ত। এ প্রবন্ধে লেখক আবদুল কাদির জীবন স্মৃতিময়তার সাথে তুলে ধরেছেন লিডিং ইউনিভার্সিটিতে কবিসাহিত্যিকদের প্রাণোচ্ছ¡ল উচ্ছ¡াস ও আনন্দের কথা। লেখক তুলে ধরেছেন ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চের কথা। একটি অনিন্দ্য সুন্দরঅনুষ্ঠান হয়েছিল সেদিন। সেদিন সিলেটের সর্বস্তরের সাহিত্য-সংস্কৃতির বোদ্ধাব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে ছিলেন দানবীর ড. রাগীব আলী। এছাড়া সেদিনকার অনুষ্ঠানে ছিলেন লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষকবৃন্দ। সত্যিই সেদিন যেন ছিল তারার মেলা। সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতির যে আলাপ সেদিন হয়েছে, তাতে ঋদ্ধ হয়েছেন সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। লেখক আবদুল কাদির জীবনের কলমে উঠে এসেছে স্মৃতিময়তা ও আবেগের কথামালা। সেদিনকার অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল দানবীর রাগীব আলীকে নিবেদিত গ্রন্থগুলোর উন্মোচন। এ অনুষ্ঠানে একজন রাগীব আলীর বহুমুখী চেতনা এবং সমাজ-সভ্যতার প্রাসঙ্গিকতা মুখ্য বিবেচনায় স্থান নিয়েছে।
দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ গ্রন্থের চতুর্থ প্রবন্ধ হচ্ছে লিডিং ইউনিভার্সিটি : প্রিয় প্রাঙ্গণ। গ্রন্থের লেখক আবদুল কাদির জীবন লিডিং ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে অধ্যয়ন করেছেন। সে হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি তাঁর খুবই প্রিয়।
স্বপ্ন, সম্ভাবনা এবং সাফল্যের পথ-পদ্ধতির রূপরেখা তিনি এখান থেকেই লাভ করেছেন। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিচরণে যে মুখ্য উপায়উপকরণ-উপাদানÑতা তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই লাভ করেছিলেন। সাথে পেয়েছিলেন একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার দীক্ষাটাও। তাই এ ক্যাম্পাসকে নিয়ে তাঁর রয়েছে স্বতন্ত্র আবেগ-অনুভূতি ও ভালোবাসা। এ প্রবন্ধে তিনি লিডিং ইউনিভার্সিটির দেশ ও সমাজে প্রাসঙ্গিকতা; শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানকে তিনি মূল্যায়ন করেছেন তত্ত¡-তথ্য-উপাত্তের নিরীখে। এছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়কে উপস্থাপন করতে গিয়ে একজন দানবীর রাগীব আলীর বহুমুখী প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি উল্লেখ করেছেন। লেখক আবদুল কাদির জীবন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, সৃজনশীলতা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং মানবিক গুণাবলি অর্জনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতাকে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষাঙ্গিক নানাবিষয় ও সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে।
দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ গ্রন্থের পঞ্চম প্রবন্ধ হচ্ছে লিডিং ইউনিভার্সিটি ৩য় সমাবর্তন : এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় লিডিং ইউনিভার্সিটির ৩য় সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদের প্রতিনিধি হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন সিলেটের কৃতিসন্তান বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান দানবীর ড. রাগীব আলী এবং তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ গ্র্যাজুয়েটগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন অতিথিবৃন্দ। জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে এ দেশকে গঠনের জন্য তাদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানানো হয়। প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন অত্যন্ত সুন্দরভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের স্মৃতিকে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন শিক্ষার প্রচার-প্রসার এবং গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ অবদানকে। দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ গ্রন্থের ষষ্ঠ প্রবন্ধ হচ্ছে ইউনিভার্সিটিতে স্মরণীয় একটি সংক্ষিপ্ত শিক্ষাসফর। এটিকে ভ্রমণবিষয়ক ফিচার বা স্মৃতিচারণই বলা যায়। এতে তিনি ভ্রমণবিষয়ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন।
ব্যক্তিজীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট অধ্যয়ন এবং ভ্রমণের যে ভিন্নতাত্তি¡ক দর্শন, তা তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছেÑএকজন আদর্শ শিক্ষকের শিক্ষাদান ও পদ্ধতির স্বরূপ। আনন্দ এবং উপভোগ্যের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান কখনো সাধারণ শিক্ষাপদ্ধতির সমতুল্য হতে পারে না। প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদানের যে প্রভাব মননে রেখাপাত করেন, তা-ই ফুটে উঠেছে লেখক আবদুল কাদির জীবনের লেখায়। এছাড়া শিক্ষাসফরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মন ও মননে বিশ্বজগত সম্পর্কে জানার যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়, তার সুদূরপ্রসারী ফলাফলকেই তিনি মুখ্য বিবেচনায় এনেছেন। ব্যক্তিজীবনের একগেঁয়েমি কিংবা গতানুগতিক প্রবণতার বহির্ভূত একটি দর্শনকে উপস্থাপনে লেখক আবদুল কাদির জীবন সচেষ্ট হয়েছেন।
দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ গ্রন্থে প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন একটি ব্যতিক্রমধর্মী লেখাকে স্থান দিয়েছেন। মূলত লেখাটি একজন জ্ঞানসাধক ও আদর্শ শিক্ষককে নিয়ে। লেখক আবদুল কাদির জীবনের প্রিয় শিক্ষক হচ্ছেন প্রফেসর ড. গাজী আব্দুল্লা-হেল বাকী। আর তাঁকে নিয়েই তিনি লেখাটি সাজিয়েছেন। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনে কতটা প্রভাববিস্তার করতে পারেন, তার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছেন প্রফেসর ড. আব্দুল্লা-হেল বাকী। তিনি একাধারে কবি, লেখক, অনুবাদক, গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক। সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার উকশা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী ড. আব্দুল্লা-হেল বাকী একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মেধা-মনন ও প্রতিভার বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। মূলত লিডিং ইউনিভার্সিটিতে যে কয়েকজন শিক্ষক তাঁদের চিন্তাচেতনা এবং মনন দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যবোধ গঠনে অনুপ্রাণিত করেছেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রফেসর ড. আব্দুল্লা-হেল বাকীর জীবনটা বর্ণাঢ্য আলোয় ঘেরা। শিক্ষা কিংবা কর্মজীবনে দুটিতেই সম্মানজনক অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা-সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য রেখেছেন। প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন অত্যন্ত সুন্দরভাবে তাঁর শিক্ষকের জীবন ও কর্মকে তুলে এনেছেন। তুলে এনেছেন লিডিং ইউনিভার্সিটির একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের কথা, যিনি তাঁর ব্যক্তিচরিত্র ও শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ গ্রন্থে সর্বশেষ সাক্ষাৎকার নামক একটি বিষয়কে জুড়ে দিয়েছেন। মূলত লিডিং ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. মো. কামরুজ্জামান চৌধুরীর সাথে তাঁর কৃত সাক্ষাৎকারটিই তিনি এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সিলেটের শিক্ষাব্যবস্থার কথা; পুরো সিলেট অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সমস্যা এবং সম্ভাবনার দিকগুলো। এছাড়া মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপারেও তার পরিশীলিত দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে সাক্ষাৎকারটিতে। একটি অঞ্চলকে শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গবেষণায় কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারেও তার সুদূরপ্রসারী মনোভাব অভিব্যক্ত হয়েছে। সর্বোপরি একটি আদর্শ জাতি নির্মাণে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার নীতি-ক্সনতিকতা এবং মূল্যবোধকে জাগ্রত করণে তিনি মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করেছেন। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাÐের ব্যাপারে তার সোচ্চার মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও নানান সমস্যা-সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন প্রফেসর ড. মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী। প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। সাক্ষাৎকারে উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গি যেমন একটি দেশকে নির্মাণে ভূমিকা রাখবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা-জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রেও তেমনই একটি দিক-নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির জীবন রচিত দানবীর রাগীব আলী ও লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রিয় প্রাঙ্গণ গ্রন্থটি একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম। এ গ্রন্থের মাধ্যমে লেখকের সৃজনশীলতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং কর্মসাধনার যথেষ্ট প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। তাছাড়া একজন দানবীর রাগীব আলীর অবদান ও মূল্যায়নকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা অত্যন্ত আশাবাদী বিষয়। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন, সিলেট। গ্রন্থটির ফ্ল্যাপ-ভূমিকা লিখেছেন ক্সদনিক সিলেটের ডাকের নির্বাহী সম্পাদক খ্যাতিমান গবেষক আবদুল হামিদ মানিক। গ্রন্থটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে সিলেটের কৃতিসন্তান বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে। গ্রন্থটির শুভেচ্ছামূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ২০০ টাকা। এ গ্রন্থের মাধ্যমে লেখক আবদুল কাদির জীবন প্রবন্ধ রচনায় অগ্রবর্তী হলেন। আমি সাহিত্যাঙ্গনে তার দীপ্ত পথচলা ও সাফল্য কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক।