কবি তিনি যিনি সৃষ্টি করেন কবিতা। ভালোবাসেন মা মাটি আর মানুষ এবং পৃথিবীর সৌন্দর্য। তাঁর শিল্পের মধ্যে আঁকা হয় প্রেম-ভালোবাসা, দেশপ্রেম, বিচ্ছেদ, উদাসীনতা, অকারণ উচ্ছ্বাস, একাকীত্ব বোধ, মনস্তাত্ত্বিক সংকট, সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি প্রভৃতি।
বাংলা ভাষার প্রধানতম আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। অর্থাৎ কবিতা লিখলেই কেউ “কবি” হয়ে যান না। বিখ্যাত কবি ‘গুইলউম অ্যাপোলিনেয়ারের’ হাতের লেখায় রচিত মনুষ্য আকৃতির কবিতা (১৯১৮) “যিনি শব্দের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য্যমুখর শৈল্পিক প্রয়োগের মাধ্যমে কোন একটি বা একাধিক বিষয়ের অনুপম ভাবধারার শ্রুতিমধুর, সৃজনশীল, ছন্দোবদ্ধ কথামালাকে কল্পনা কিংবা বাস্তবতা অথবা উভয়ের সংমিশ্রণে প্রকাশ করেন এবং তা পাঠকের চিত্তকে আকৃষ্ট ও মোহিত করে; তিনিই কবি।”
আজ আমরা একজন প্রকৃত কবির সাথে মিলিত হয়েছি। যেনি শব্দ বুনেন, স্বপ্ন দেখেন মানুষ প্রকৃতির প্রেম নিয়ে, ভালোবাসেন বাংলার মা মাটি আর মানুষ। যিনি বিশ্বের বুকে পদচিহ্ন রাখতে চান সত্য ও সুন্দরের। তিনি হলেন সত্য ও সুন্দরের কবি আশরাফ হাসান। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমরা জানবো কবির কবিতা, সৃষ্টিশীলকর্ম ও জীবন সম্পর্কে। তাহলে আর দেরি কেন শুরু করা যাক।
আবদুল কাদির জীবন : আসাসালামু আলাইকুম। আপনি কেমন আছেন?
আশরাফ হাসান : ওয়ালাইকুম সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
আবদুল কাদির জীবন : আমেরিকাতে বসে কাব্যিক আড্ডা বা সাহিত্য আড্ডা কেমন চলছে?
আশরাফ হাসান : আমেরিকায় আমাদের সাহিত্য আড্ডা দেশ থেকে কোনো অংশে কম নয়। যদিও প্রবাসে প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে হয় তবুও যারা সাহিত্যের সাথে গেরস্থালি করেন তারা পুরোদমেই সাহিত্য আড্ডায় মেতে থাকেন। এখানে হয়তো প্রতি সপ্তাহে এই আড্ডা দেয়া কঠিন; মাসে বা বড়জোর ১৫ দিনে একবার; তারপরও বলবো ভার্চুয়াল আড্ডা সব সময় লেগেই থাকে।
আবদুল কাদির জীবন: বাংলাদেশি অনেক লেখক আছেন যারা আমেরিকায় বসবাস করছেন এবং লেখালেখি করছেন তাদের সাথে আপনার দেখা হয় কি, হলে কাদের সাথে হয়?
আশরাফ হাসান: আমেরিকায় বিশেষ করে পৃথিবীর রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্কে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবি-লেখক-সাহিত্যিকের অবস্থান। হ্যাঁ তাদের সাথে আমার দেখা হয়। নিয়মিত যোগাযোগ হয়। বিশেষ করে কবি তমিজ উদদীন লোদী, কবি শাহীন ইবনে দিলওয়ার, প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌস, কবি কাজী আতিক, লেখক-সাংবাদিক সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহের, লেখক ও সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকা সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি এম এম শাহীন, লেখক- সাংবাদিক হাবিব রহমান, লেখক ও আইটিভি পরিচালক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি কাজী জহিরুল ইসলাম, প্রাবন্ধিক আদনান সৈয়দ, কবি শিউল মনজুর, কবি এইচ বি রিতা, কবি সোনিয়া কাদির, কবি বেনজির শিকদার, কবি জুলি রহমান, কবি স্বপ্ন কুমার, লেখক রশীদ জামিল, কবি মাসুম আহমদ, কবি হাবিব ফয়েজি, কবি মোখলেছুর রহমান, লেখক আবুল বাশার, কবি রওশন হাসান, কবি আহমেদ ছহুল, লেখক রশীদ আহমদ আরও অনেক। এ মুহূর্তে নাম মনে আসছে না। তাছাড়া নিউইয়র্কের বাইরের স্টেট থেকে নিয়মিত যোগাযোগ হয় কবি ও অনুবাদক রাজিয়া সুলতানার সাথে।
আবদুল কাদির জীবন : স্বদেশের কথা কেমন মনে পরে আপনার?
আশরাফ হাসান : স্বদেশের কথা প্রতিদিন মনে পড়ে। শিল্পী যেমন গেয়ে উঠেন-
‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য রাগে
প্রতিদিন তোমার কথা হ্নদয়ে জাগে…’
আবদুল কাদির জীবন: আপনার লেখালেখি শুরু কখন থেকে?
আশরাফ হাসান: মূলত আমার লেখালেখি শুরু যখন আমি ৯ম শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকে। অর্থাৎ ১৯৮৮ সাল থেকে।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার প্রথম কবিতা কখন, কোথায়, কিভাবে প্রকাশ হলো?
আশরাফ হাসান: আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে যখন আমি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। মাদ্রাসার বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘সোপান’- এ সম্ভবত ‘ঈদের দিনে’ শিরোনামে কবিতা প্রকাশিত হয়। ম্যাগাজিনটি আগলে রেখেছিলাম দীর্ঘদিন। কিন্তু প্রাণী ইঁদুর ও মানুষ ইঁদুর মিলে সেটি একদিন খেয়ে ফেলে।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার লেখালেখির চিন্তা মাথায় আসল কিভাবে?
আশরাফ হাসান: সত্যি বলতে শৈশব থেকেই আমি একটু ভাবুক প্রকৃতির ছিলাম। জোসনার রূপ, পাখির সুর ও পালক, নদীর কলতানে অভিভূত হতাম দারুণভাবে। অন্যরকম অনুভূতি ভেতরে নাড়া দিয়ে যেতো। মনে আছে যখন ৭ম, ৮ম, ৯ম শ্রেণীতে পড়তাম তখন ঘরে থাকা দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা, ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়তাম। খুব ভালো লাগতো। বিভিন্ন চরিত্রের ঘনিষ্ঠ দর্শক হয়ে যেতাম। প্রথম কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট বেশ নাটকীয়। বড় ভাই আহমদ হাসান (মরহুম) একদিন মাসিক ফুলকুড়ি নামক একটি ম্যাগাজিন নিয়ে আসেন। সেটা পড়ছিলাম। সেখানে একটি ঈদ বিষয়ক কবিতা বেশ ভাল লাগে। এটা আমাকে এতো বেশি আলোড়িত করে যে ঐদিনই আমি একটি কবিতা লিখে ফেলি।
এর জবাব মনে হয় সংক্ষেপে আগেই দিয়েছি। মানে আমি স্বতস্ফুর্তভাবেই লেখার প্রতি আকৃষ্ট হই। আশির দশকের শেষ এবং নব্বই দশকের গোড়া থেকে আমার লেখালেখিতে হাতেখড়ি হলেও নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে বলবো উত্তরণ ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্ট’র সাপ্তাহিক সাহিত্য আসরগুলোতে আমার নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। প্রথমত এই সংগঠনের হাত ধরে আমার লেখার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। তখন বেশির ভাগ আসর অনুষ্ঠিত হতো তৎকালীন সেক্রেটারি কবি রাগিব হোসেন চৌধুরীর পাঠানটুলাস্থ বাসায়। কিছুদিন আমার প্রতিবেশী অভিভাবক সদৃশ কবি ডাক্তার আব্দুস শহীদ খানের (মরহুম) মজুমদারীর বাসায় আড্ডা হয়েছে। তারপর অনেকদিন সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি অধ্যক্ষ কবি আফজাল চৌধুরীর মিরাবাজারের বাসায় আসর হয়েছে। এতে লেখাপাঠ করতাম। আলোচকগণ বিস্তারিত আলোচনা করতেন। এ আলোচনা ছিল ওয়ার্কশপধর্মী। তাই হাতে কলমে শেখার সুযোগ ছিল। এরপর নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাপ্তাহিক সাহিত্য আসরে যাওয়া শুরু। সাহিত্য সংসদে আলোচনা-সমালোচনার পথ ধরে লেখার আরেক ধাপ উত্তরণ ঘটে। তখন সেখানে নিয়মিত আলোচনা করতেন কবি-ছড়াকার শারিক শামসুল কিবরিয়া (মরহুম), সাহিত্যিক-সাংবাদিক আজিজুল হক মানিক, কবি রাগীব হোসেন চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক সেলিম আউয়াল, কবি কামাল তৈয়ব প্রমুখ। মজার বিষয় হলো আমার লেখার উপর তীক্ষ্ণ সমালোচনা করতেন সেলিম আউয়াল আর প্রশংসা করতেন রাগীব হোসেন চৌধুরী ও আব্দুস শহীদ খান। তাত্ত্বিক ও গঠনমূলক চমৎকার আলোচনা করতেন শারিক শামসুল কিবরিয়া ও আজিজুল হক মানিক। নিয়মিত লেখাপাঠ করতেন বাছিত ইবনে হাবীব, ফায়াসাল আইয়ূব, আনোয়ার হোসেন মিছবাহ, নুরুস সুফিয়ান চৌধুরী, আব্দুল কাইয়ুম, মতিউল ইসলাম মতিন, আবিদ ফায়সাল, মুহিতুর রহমান মোহিত, সিরাজুল হক, সাঈম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম আরো অনেকে। এখানে একটি বিষয় না বললে কৃপণতা হবে। আমার লেখক জীবনে সবচেয়ে বেশি যার অবদান তিনি শারিক শামসুল কিবরিয়া। হাতে কলমে শিখিয়েছেন। অসম্ভব অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন রাগীব হোসেন চৌধুরী, ইতিহাসবিদ মনির উদ্দীন চৌধুরী, অধ্যক্ষ কবি আফজাল চৌধুরী, কবি আব্দুস শহীদ খান, লেখক-গবেষক তাবেদার রসুল বকুল, কবি দেওয়ান এ এইচ মাহমুদ রাজা চৌধুরী, সেলিম আউয়াল, প্রাবন্ধিক রকিব আল হাফিজ প্রমুখ। উল্লেখযোগ্য যে এ সময় সাহিত্য সংসদ কর্তৃক সর্বপ্রথম তরুণ লেখক পদক প্রবর্তিত হয় এবং আমি ১৯৯৭ সালে এ পদক অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করি। মনে আছে ঐদিন সুলেমান হলে বিশাল আয়োজন ছিল। জাতীয় অধ্যাপক দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ও জাতীয় অধ্যাপক কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর হাত থেকে ক্রেস্ট, সনদপত্র গ্রহণ করি। সাহিত্য সংসদের সভাপতি ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রাগীব হোসেন চৌধুরী। বলতে দ্বিধা নেই এ অর্জনের মাধ্যমে লেখালেখিতে আমার উৎসাহ অনেকগুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া নয়ের দশকের প্রথম থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রে নিয়মিত কবিতা ও কথিকা পাঠ করতাম।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার লেখাপড়া সম্পর্কে জানতে চাই।
আশরাফ হাসান: আমার লেখাপড়ার হাতে খড়ি আমার বাবার কাছে। মনে আছে শৈশব থেকেই বাবা মাওলানা সঈদুল হাসান (১৯২৪ – ২০১০) যিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ও অধ্যক্ষ ছিলেন, আমি ও আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই আসজদ হাসানকে (অবিবাহিত অবস্থায় ২০০২ সালেলে ইন্তেকাল করেন) বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করতেন। আমরা এই দুই ভাই আট ভাই দু’ বোনের যথাক্রমে ৭ম ও ৮ম ছিলাম। এরপর আমাদের দুজনকে সিলেটে আম্বরখানা বড় বাজারের নিজ বাসার পার্শ্ববর্তী সরকারী কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। পাঠশালায় বেশ মেধার স্বাক্ষর রেখে আমরা দুজন পড়ালেখা সমাপ্ত করি। ক্লাসে বরাবরই আমরা ফার্স্ট বয় ছিলাম। সহপাঠী দু-চারজনের মধ্যে খুব কম্পিটিশন ছিল। অনেক চেষ্টা করেও কেউ প্রথম স্থান দখল করতে পারেনি। তবে একবার ক্লাস ফোরে ষান্মাসিক পরীক্ষায় সহপাঠী তাহমিনা আমার চেয়ে একটু বেশি মার্ক পেয়ে ১ম হয়ে যায়। এর কারণ আমি পরীক্ষার সময় জ্বরে আক্রান্ত ছিলাম এবং অসুস্থতা নিয়েই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। অবশ্য বার্ষিক পরীক্ষায় আবার মেধা তালিকায় ১ম স্থানে আসীন হই। সহপাঠী তাহমিনা একারণে মনে হয় আমার স্মৃতিতে রেখাপাত করে আছে। অবশ্য সে আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিল এবং মেধাবী ছিল। ফলে মেধার দৌড়ে আমাকে পেছনে ফেলা তার জন্য কিছুটা সহজ ছিল।
সে যাক, পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হই সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। আমি ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পাইনি। তবে ৮ম শ্রেণীতে মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সিলেট বিভাগে আসা মাত্র ২টি বৃত্তির একটির পাশে আমার নাম দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাই। অবশ্য আমার মনে আছে এ বৃত্তি পরীক্ষার জন্য বিশাল প্রস্ততি নিয়েছিলাম। বেশ অধ্যবসায় ছিল। অসামান্য পরিশ্রম করেছি। সে হিসেবে ফলও পেয়েছি। আমার জীবনে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার জন্য এতোবেশি যত্ন কিংবা পরিশ্রম করিনি। ৮ম শ্রেণীতে আমার চেয়ে অনেক বয়েসে বড় একজন ভর্তি হয়। বার্ষিক পরীক্ষায় সে অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার চেয়ে সামান্য বেশি মার্কস পেয়ে যায়। ফলে সে মেধা তালিকায় আমাকে পেছনে ফেলে শীর্ষে চলে আসে। এ ঘটনাটি আমার মনোবলকে কিছুটা দুর্বল করে দেয়। পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে কৈশোর মন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এর পেছনেও কিন্তু বয়েসের ফারাক একটা বড় কারণ ছিল।
এরপর মানবিক বিভাগ থেকে দাখিল (এসএসসি সমমান), আলিম (এইচএসসি সমমান) ও ফাজিল (স্নাতক) অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত ইতোমধ্যে আমি শারিরীকভাবে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ি। ফলে অনেক চেষ্টার পরও কামিল ক্লাস সমাপ্ত করতে পারিনি। এ অসুস্থতা আমার একাডেমিক ও লেখক জীবনের জন্য প্রভুত ক্ষতির কারণ। অবশ্য এখানে City University of New York- এ অ্যাসোসিয়েট করছি। দুই সেমিস্টার বাকি। শেষ করবো আশা করছি।
আবদুল কাদির জীবন: আপনি দেশে থাকতে বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। এই পেশায় কিভাবে আশা হলো?
আশরাফ হাসান: শিক্ষকতা দিয়ে আমার কর্মজীবন শুরু। দেশে কয়েকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল , কলেজিয়েট স্কুল, প্রাইভেট কলেজে শিক্ষকতা করেছি। প্রবাসেও পেশা হিসেবে প্রধানত শিক্ষকতা নিয়ে আছি। বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমার পিতার ইচ্ছা ছিল আমি যেনো শিক্ষকতা করি। আমারও একটা আগ্রহ তৈরি হয়। হয়তো পারিবারিক ট্রাডিশন সেদিকে ধাবিত করেছে। এর পাশাপাশি দীর্ঘ সময় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। লেখালেখির কারণে সেদিকে ঝোঁক ছিল। বেশ কিছুদিন ম্যারেজ রেজিস্ট্রোর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে হযেছে। বলতে পারেন অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য।
আবদুল কাদির জীবন: সিলেট মোবাইল পাঠাগার নিয়ে আপনার অনেক স্মৃতি আছে, কিছু স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা সেয়ার করতে পারেন।
আশরাফ হাসান: হ্যাঁ সিলেট মোবাইল পাঠাগারের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ঘনিষ্ঠ সঙ্গি ছিলাম। অনেক সুখদ আবার কিছু বিষাদময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বলতে অনেক লম্না সময় প্রয়োজন। অনেক সময় দিয়েছি। নয়ের দশকের পরে এ পাঠাগার ও সাহিত্য আসরকে ঘিরে উল্লেখযোগ্য কিছু কবি-লেখকের সমাগম ঘটেছিল। তবে এ ধারাবাহিকতা আমরা যারা নয়ের দশকের মেইন স্ট্রিমে ছিলাম তাদের হাত ধরেই। একটা স্মৃতি বিশেষভাবে মনে পড়ছে। এর উদ্বোধনের পর এটার স্বপ্নদ্রষ্টা ইতিহাসবিদ মনির উদ্দিন চৌধুরী আমাকে ফোন করে বললেন, তুমি শীঘ্রই মোবাইল পাঠাগারে নির্বাহী হিসেবে যোগদান করো।
আমি সহজেই বলে ফেললাম, আমার তো সময় নেই। এ কাজে আপনি কবি আবিদ ফায়সালকে নিয়ে আসতে পারেন। অবশ্য মনির ভাই সেটাই করেছিলেন। আমি ও আবিদ ফায়সাল দীর্ঘদিন সেখানে একসাথে কাজ করেছি। সাহিত্যপত্র ‘ছায়ালাপ’ সম্পাদনা করেছি। সম্ভবত এই নামটি আমার দেওয়া। বলবো আবিদ ফায়সাল সময়নিষ্ঠ, কর্মনিষ্ঠ ছিলেন। মনির উদ্দিনের মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান লেখক আতাউর রহমান পীর, কবি-সংগঠক দেওয়ান এ এইচ মাহমুদ রাজা চৌধুরী, আবিদ ফায়সাল, মহিউদ্দিন চৌধুরী, কবি আব্দুল হান্নান প্রমুখ এর হাল ধরেন।
আবদুল কাদির জীবন: বাংলাদেশে সিলেটের ডাক সহ বিভিন্ন পত্রিকায় আপনি কাজ করেছেন। সাংবাদিকতার শুরু এবং শেষ এ বিষয়ে আলোকপাত করলে খুশি হতাম?
আশরাফ হাসান: এটার জবাব মনে হয় আগে কিছু এসেছে। আমি দেশে অবস্থান কালে দৈনিক সিলেট বাণী, দৈনিক কাজির বাজার, দৈনিক প্রভাত বেলা এবং সবশেষে দৈনিক সিলেটের ডাক’-এ সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। প্রথমে দৈনিক কাজির বাজার পত্রিকায় (প্রথম যখন প্রকাশিত হয়) স্টাফ রিপোর্টার ও সহ- সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। প্রবাসেও সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা’র সাথে জড়িত এবং Channel 786 এর সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার এখন পর্যন্ত কতটি বই প্রকাশ হয়েছে? সেগুলোর নাম কী কী?
আশরাফ হাসান: কবি আশরাফ হাসানের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ: ১. দিগন্ত আজ বৃষ্টি ভরা (যৌথ- ১৯৯৭) ২. দশ আকাশে একশ’ তারা ( যৌথ- ১৯৯৯) ৩. সুরাহত সামগীত (২০১৪) ৪. পাখিলৌকিক জোছনা (২০১৯) ৫. রাইফেলগুলো প্রত্যাহার করে নাও (২০২০) ৬. নির্বাচিত কবিতা (২০২২) ৭. মৃত্তিকাসুন্দর (২০২৩)।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার অনেক পরিচিত লেখক আছেন। আপনার মনে পরে এরকম কবি, গল্পকার, ছড়াকার, লেখক, সাংবাদিকের নাম জানতে চাই।
আশরাফ হাসান: অধ্যাপক ড. শফিউদ্দিন আহমদ, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদ, কবি আব্দুল হান্নান, কবি কালাম আজাদ, কালাম আজাদের পর কবি ড়. মাহবুব হাসান, কবি ড. ফজলুল হক তুহিন, গবেষক রুহুল ফারুক, কথাসাহিত্যিক ডা. আব্দুল হাই মিনার, কবি শারিক শামসুল কিবরিয়া, কবি মুকুল চৌধুরী, কবি (কর্নেল) সৈয়দ আলী আহমদ, লেখক অধ্যাপক আতাউর রহমান পীর, কবি কবি আব্দুল বাসিত মোহাম্মদ, কবি কামাল তৈয়ব, কথাসাহিত্যিক সাঈদ চৌধুরী, গবেষক তাবেদার রসুল বকুল, কবি লাভলি চৌধুরী, কবি হীরা শামীম, কবি মাহবুবা সামসুদ, প্রাবন্ধিক আমেনা আফতাব, কবি অধ্যাপক জফির সেতু, কবি লায়েক আহমেদ নোমান, প্রাবন্ধিক রকিব আল হাফিজ, কথাসাহিত্যিক সেলিম আউয়াল, ছড়াকার মতিউল ইসলাম মতিন, কবি সালাহউদ্দিন সেলিম, কবি বাছিত ইবনে হাবিব, কবি আবিদ ফায়সাল, গবেষক সৈয়দ মবনু, কবি ফায়সাল আইয়ূব, কবি নুরুস সুফিয়ান চৌধুরী, কবি আবদুল কাইয়ূম, কবি মোহিত রহমান, কবি শায়েখ তাজুল ইসলাম, কবি নাজমুল আনসারী, কবি মামুন সুলতান, ছড়াকার সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী, প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ মারুফ, গল্পকার সাঈম চৌধুরী জুবের, কবি দেওয়ান মাহমুদ রাজা চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক সিরাজুল হক সহ আরো অনেক।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার প্রিয় কবি কে? আপনি কোন কবির কবিতা বেশি পড়েন?
আশরাফ হাসান: এ মুহূর্তে যাদের মুখ স্মৃতিতে ভেসে উঠছে তাদের নাম বলি: কবি আল মাহমুদ, কবি দিলওয়ার, কবি আফজাল চৌধুরী, কবি আল মুজাহিদী, কবি ডা. আব্দুস শহীদ খান, গবেষক হারুন আকবর, কবি রাগিব হোসেন চৌধুরী, গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, ইতিহাসবিদ মনির উদ্দিন চৌধুরী, প্রাবন্ধিক আব্দুল হামিদ মানিক, সাহিত্য সমালোচক আজিজুল হক মানিক।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার জীবনের একটা সফলতার গল্প শুনতে চাই।
আশরাফ হাসান: আমার সাধারণ অর্থে সুখের কোনো গল্প নেই বললে চলে। তবে আমার কবিতা কিংবা লেখা যখন কারো হ্নদয় ছুঁয়ে যায় বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তখন খুব ভালো লাগে। উপভোগ করি।
আবদুল কাদির জীবন: আপনার জীবনের একটা দুঃখের গল্প শুনতে চাই।
আশরাফ হাসান: আমার জীবনে দুঃখের গল্পই বেশি। প্রবাসে সর্বাধিক ব্যস্ত জীবন। অল্প পরিসরে সেটা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে প্রধান গল্পটা হলো একসময় সিরিয়াস অসুস্থতার কারণে জীবনের অনেক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
আবদুল কাদির জীবন: বাকি জীবনের জন্য কি প্রত্যাশা করেন?
আশরাফ হাসান: বাকী জীবন মানুষের জন্য লিখে যেতে চাই। মানুষকে সুন্দরকে সত্যকে ভালোবেসে যেতে চাই।
আমি বলবো একজন লেখক বা সাহিত্যকের কোনো সময় কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত করা উচিত নয়। কারণ মানুষ তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে অধিক ভালোবাসা ও দায়িত্ব বোধ প্রত্যাশা করে।
আবদুল কাদির জীবন: মানুষের জন্য আপনার উপদেশ কী ?
আশরাফ হাসান: মানুষের জন্য আমার উপদেশ- সত্য- সুন্দরের প্রেমিক হোন।
আবদুল কাদির জীবন: আমাকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আশরাফ হাসান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সিলেট লেখক পরিষদ কেন্দ্রীয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল কাদির জীবন।