‘আপনি যাইবা আমরার লগে’ ম্যাসেঞ্জারে হৃদয়জ কথা কয়টি দেখে হঠাৎ ঢেউয়ের কবলে পড়া নৌকার মাঝির মতো মনের ভেতর একটা দোল খেলে যায়। স্নিগ্ধতায় মোড়া কথাগুলোর এমন তেজ সপ্তাহান্তে আমার সমস্ত প্লেন প্রোগ্রামটা উলটপালট করে দিলো। গেলো ক’দিন সিলেট মোবাইল পাঠাগারের ৭৭৭ সাহিত্য আসর এবং আনন্দ ভ্রমন নিয়ে ফেসবুকে বেশ একটা ঝড় তুলেছেন একদল অভিযাত্রী সাহিত্য সৈনিক, ঝড়ের বার্তা অনেকের মতো আমারও চোখ এড়িয়ে যায়নি। বার্তাটি শহর থেকে একটু দূরে ভ্রমনের এক বর্ণাড্য আয়োজন। আমার তাতে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা ছিলো একেবারেই তলানিতে। কিন্তু কবি ইশরাক জাহান জেলির অনুনয়মাখা আহবান তোড়তে ভয় করছিলো হৃদয় ভাঙ্গার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় যদি পাছে। ভাবলাম আমার জায়া ফাহমিদাকে লগে নিয়ে নিলে কেমন হয়। এমনসব ভ্রমনে ওর আগ্রহ বেশ। বলতেই গাঁট বেঁধে তৈরি।
অভিযাত্রা শুরু হলো। ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশ শনিবার। ‘সৃষ্টির উল্লাসে লাগুক প্রাণের প্রপাতে প্রান’ শ্লোগানের ব্যানার নিয়ে সাদা পাথর বাসে আমরা চড়ি। জাফলং তামাবিল পথে বাসের চাকা ঘুরতে শুরু করে সকাল এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিটে। ওই পথেই শহর থেকে একটু দূরে পিরের বাজার টিকরপাড়ায় ডা.বাহার ভাইয়ের বাংলো আমাদের গন্তব্য, দেরি হয়নি পৌঁছাতে খুব। পথের যে সময়টুকু তরুণদের গানের মূর্ছনায় তাও গায় লাগেনি।
হযরত শাহ সুন্দর( র.)-র মাজার লিখা বিরাট গেটের ভেতর দিয়ে আমাদের বাস বাঁক নেয়। আঁকাবাঁকা গ্রামের পথ দিয়ে একটু এগোতেই টিকরপাড়ায় ছোট্ট একটি টিলার ওপর বাংলো। বাংলোর নিচে বাস থামে।সবুজ গাছ গাছালিতে ভরপুর বাংলোটি গাছের শাখা পাতায় আড়াল করে রেখেছে। চোখে পড়ে আবছা আবছা। সবাই টিলা বেয়ে ওপরে উঠি। প্রথমেই নজর কাড়ে এক ঝাঁক সাদা হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে আমাদের সামনে দিয়ে হেটে যায় এক ট্রুপ সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের মতো। ওদের হাবেলিতে যেন আমাদের স্বাগতম। বাংলোটি দু’তলা।পাঁচ ছ’টা সিঁড়ি ভেঙ্গে মূল দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ।ভেতরে আরেকটা ছোট লোহার সিঁড়ি দুই তলার মধ্যে সেতুর কাজ করে। লাল ইটের গাঁথুনিতে আধুনিক যুগের রঙচঙে দেয়াল। গাছের গুড়ি দিয়ে বানানো বসার টুল টেবিল। থাকার জন্য যা প্রয়োজন সব সুবিধা আছে। কিন্তু থাকার কেউ নেই। বাহার ভাই নিজেও মাত্র এক রাত কাটিয়েছেন বাংলোতে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠি।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে অন্ধকার হয়ে যায় ভেতর। জানালার পর্দা ঠেলে কিছু আলো ঢুকে ভেতরে চলে আলো আধারির খেলা। বারান্দায় গাছের গুড়ি কেটে বানানো টুলে বসে একটু জিরোই। নিচে লেকের পারে তাকিয়ে দেখি দু’টো সৈকত ছাতার নিচে পাতানো চেয়ারে কবি কালাম আজাদ, প্রফেসর ড. কামাল আহমদ চৌধুরী, কেমুসাসের সাহিত্য সম্পাদক আহমদ মাহবুব ফেরদৌস, গল্পকার সেলিম আউয়াল, কেমুসাস ভাষা সৈনিক মতিন উদ্দিন আহমদ যাদুঘরের পরিচালক ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার, কেমুসাসের সাবেক সভাপতি হারুনুজ্জামান চৌধুরী, কবি সালেহ আহমদ খসরু, কেমুসাসের সহসভাপতি বিশিষ্ট সংগঠক অধ্যাপক দেওয়ান এ. এইচ. মাহমুদ রাজা চৌধুরী, প্রাবন্ধিক শামসীর হারুনুর রশীদ,বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুল কাদির তপাদার গোল হয়ে বসা। নেমে যোগ দিই তাতে। ছোটখাটো এ আড্ডায় খানিক উষ্ণতা ছড়ালে বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়েন সবাই। ‘পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়, ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভুলা যায়’। এরই ফাঁকে বাংলোর সিঁড়ি ঘেঁষা বিরাট এক মুন্ডানো গাছের শেকড়ের ওপরে দু’টি বাঁশে টানানো হয় সাহিত্য সভার ব্যানার। সবার গলায় পরিয়ে দেয়া হয় মোবাইল পাঠাগারের লোগো ছাপ দেয়া সবুজ রঙয়ের উত্তরীয়। অপূর্ব লাগছিলো সবার গায়ে এক ব্রান্ডের লেবেলে। ঠিক যোহরের নামাযের পর কবি কামাল আহমদের কন্ঠে পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সঞ্চালক ইশরাক জাহান জেলি আর আবদুল কাদির জীবন জাতীয় সংগীতের নেতৃত্ব আমার কাঁধে সঁপে দিলে সবাই দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’।
এডভোকেট ও বিশিষ্ট ছড়াকার আব্দুস সাদেক লিপনের স্বাগত বক্তব্য শেষে শুরু হয় কবিতা পাঠ, গান আর প্রবন্ধ। অনেকটা প্রতিযোগিতার আদলে প্রতি পর্বে প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় তিনজনকে পুরস্কৃত করা হয়। কবিতায় অনিন্দ্য মোস্তাক, আলেয়া রহমান ও কামাল আহমদ। গানে আব্দুর রহমান পারভেজ, মানোয়ার হোসেন আব্দাল ও সাজিদুর রহমান এবং প্রবন্ধে শামসীর হারুনুর রশীদ। দুপুরের খাবার সময় পার হয়ে গেলে সবার পেঠ চোঁ চোঁ করে ওঠে। আধা ঘন্টার বিরতি টেনে খেতে বসি সবাই। নির্ধারিত এ সময়ের পরে কেউ কেউ খাবারে ব্যস্ত থাকলেও আমরা অনুষ্ঠানে ফিরে আসি আবার। সূর্য তখোন পশ্চিমাকাশে মাথা গুজার পায়তারা করছে। মঞ্চে অতিথিদের বক্তব্য শুরু হয়।
এসময় পাখিদের বিভিন্ন সুরে ডাকাডাকি পরিবেশটাকে মুখরিত করে তোলে। এসবের ভেতর দিয়েই শুনতে পাই কবি কালাম আজাদের কন্ঠে -পাঠকতো নাই নজুরুলেরও নাইরে পাঠক ফররুখের প্রশ্ন শুনি, বলুননা স্যার রবীন্দ্রনাথ কোন দেশের! তবুও বলি, ওরে তরুণ কলমটা তুই ছাড়িসনা আসছে দিনের নোভেলটা কার সেটি তো তুই জানিস না। অসম্ভব ভালো লাগার একটি ছড়া। কবি কালাম আজাদ সবসময়ই আমার প্রিয় একজন মানুষ। রসে ভরপুর। তাঁর কথা শুনি মন দিয়ে। ড.কামাল মানুষের মেধা লালনের জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের কথা বলেছেন। হারুনুজ্জামান চৌধুরী মোবাইল পাঠাগারের সমৃদ্ধি এবং বিস্তার কামনা করেছেন। ডা. বাহার তাঁর বক্তব্যে শুধু বিনয়ই প্রকাশ করেছেন। এর পরপরই অতিথিরা আনন্দঘন এ পরিবেশে দু’টো বইয়েরও মোড়ক খোলেন কবি কাউসার জাহান লিপির ‘আয়নার রাত নেই’ ও কবি শিপারা শিপার ‘ভোরের আকাশ’। পুরো অনুষ্ঠান বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেন সাহিত্য সংস্কৃতির নিবেদিত প্রাণ কবি জুবের আহমদ সার্জন। আনন্দ এ ভ্রমনে আমরা সবাই ছিলাম সবার প্রিয়জন আর এই প্রিয়জনদের খরচ করা সময়টুকু আমরা নিজেদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পেরেছি যেটি মনের বাক্সে পুঁজি হয়ে থাকবে অনেক অনেক দিন।
আরো যাদের অংশগ্রহণে টিলার ওপর নীরব বাংলোটি এদিন গম গম করে উঠেছিলো-
এডভোকেট কবি আব্দুল মুকিত অপি, কবি সুফিয়া জমির ডেইজি, নাট্যকার ছয়ফুল আলম পারুল, কবি নাজমুল আনসারী, কবি মোস্তাক আহমদ, ফাহমিদা চৌধুরী, কবি জুবের আহমদ সার্জন, প্রাবন্ধিক মুস্তাফিজ সৈয়দ, কবি সৈয়দ রেজাউল হক, কবি কুবাদ বখত চৌধুরী রুবেল, আফিয়া সুলতানা, লেখক সৈয়দা দিবা, লেখক জাহিদা চৌধুরী, কবি লাহিন নাহিয়ান, আহমেদ সোহান ও জোবায়দা বেগম আঁখি।