আকাশ নামের ছেলেটি । তার লম্বা লম্বা চুল। দেখলেই যেনো অন্যরকম মনে হয়। ছোট বাচ্চারা দেখলে হয়তো তার বাবাকে দেখিয়ে বলবে, ‘আব্বু ঐ দেখ পাগল’। বড়োরা দেখে বলবে, মানুষের কতো বিচিত্র জীবন। কোনো কোনো সময় কাউকে দেখলেই তার চেহারায় ফোটে উঠে জীবনের আসল চিত্র। দুঃখ ভরা জীবনের নাম আকাশ।
আকাশের জীবনে বড়ো হওয়ার অনেক স্বপ্ন। বিশ্ব বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়ো’। ঠিক তেমনি আকাশ নামের ছেলেটির বিশেষত্ব ছিল শুধু তার চোখ দুটোতে । তার দুচোখ ভরা স্বপ্ন। স্বাপ্নিক চোখ নিয়ে কল্পনায় – বাস্তবে সে ঘুরে বেড়ায় দিগদিগন্তে, বিস্তৃত মাঠে, নদীর তীরে, খোলা মাঠে আকাশের নীচে একাকীত্বের মতো। এদিকে তার জীবনে আসে আরেক নতুন গল্প।
নাম বিউটি। মেয়ে যেমন নামে তেমন সুন্দরে। আকাশের স্বপ্নের সাথী, অপরূপা এক সুন্দরী, গ্রামের এক কিশোরী মেয়ে যে আকাশকে তার প্রেমে বেঁধে ফেলেছে। ছেলেটির সারাদিন কাটে মেয়েটিকে ঘিরে। বাড়ির পাশে লুকোচুরি খেলা, কানামাছি, গোল্লাচোট, একসাথে গল্প করা সহ এক সাথে স্কুল এ যাওয়া, তার সব স্মৃতি হৃদয়ের মনিকোঠায় ভাসে …. এ সবই যেনো তার নিত্য দিনের ভাবনা।
সিলেট শহরের ঐতিহাসিক আলী আমজদের ঘড়ির দক্ষিণে সুরমা নদীর পাশের সোজা রাস্তাটির পথ ধরে অপাড়ের এক ছায়া সুনিবিড় সবুজ এক ঐতিহাসিক ব্যক্তির নামে গ্রাম তৈয়ব কামাল । যেথায় জ্যোৎস্না রাতে সাঁরা গ্রাম জ্বল জ্বল করে, খোলা উঠানে গল্পের আসর জমে, গাছে গাছে ফুলে ফুলে পাখিদের আসর, বাঁশের সারিতে সাজানো প্রেমের বাঁধন। তার উপর দিয়ে ছেলেটি বিউটি কে নিয়ে স্বপ্নের সিরিতে গাড়ি যুগে চলে যায় অনেক দূর । সে ভাবে এই স্বাপ্নিক জীবন ছেড়ে সে আর কোথাও চলে যাবে না ….কখনো না।
কিন্তু প্রেমের সাগরে নিমজ্জিত তখন বিধির কতো বাধা! তা বলা বাহুল্য। ছেলেকে নিয়ে মায়ের অনেক স্বপ্ন থাকে। একদিন মায়ের স্বপ্ন পুরন করার জন্য ছেলেটিকে ভর্তি হতে হয় শহরের স্কুলে । যেদিন ছেলেটি তার গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থায়ী ভাবে চলে আসে সেদিনের রক্ত জবার মত লাল হওয়া বিউটি এর মায়াময় চোখ দুটো বলে দিয়েছিল ছেলেটির প্রতি বিউটির এর গভীর অনুরাগ এবং ভালোবাসার কথা । চলে আসার সময় ছেলেটি ও বুঝেছিল তার কি যেন ফেলে আসা হৃদয়ের অনুভূতি । শহরের নতুন পরিবেশ, নতুন পথ, নতুন বন্ধু বান্ধব, নতুন সম্পর্ক, নতুন সবকিছু, পড়াশুনার প্রতিযোগিতা সব ছাপিয়ে ছেলেটির মনে সবসময় ধরা দেয় তার সেই গ্রাম … যে গ্রামে বসবাস করে তার প্রিয়তমা, তার চলার সাথী বিউটি ।
তাই যখনই স্কুল ছুটি হয় তখনই সে ফিরে আসে তার স্বপ্নের রাজ্যে… তার বিউটির কাছে । অনেক দিনের না বলা হাজার কথা হৃদয়ে ফোটে তখন বিউটির ।
এক সময় ছেলেটির পড়াশুনার চাপ বেড়ে যায়। গ্রামে আসার তেমন সুযোগ হয়না তার। একদিন সে শুনতে পায় বিউটির পরিবার সহ চলে গেছে কোন এক পাহাড় ঘেরা শহরে তার বাবার কাছে । এর পর ছেলেটির চারদিকে তার মনে পিনপতন নিরবতা এবং শূন্যতা বিরাজ করে …বুকের গভীরে কোন এক খানে বিউটির জন্য জমেছে এক মায়া… তাকে এক পলক দেখতে পাওয়ার কি আকুলতা। … এটার নাম কি ভালবাসা? ভালোবাসার রং কি দেখা যায়?
এর পর আকাশের বৃষ্টির মতো চোখের জল অনেক গড়ায় । ছেলেটি একদিন জানতে পারে তার বিউটি গ্রামীণ সমস্ত স্বপ্ন ভুলে বাসা বেঁধেছে কোন এক শহুরের আধুনিক ছেলের বুকে । সেদিন ছেলেটির দু চোখে অঝোর ধারায় শ্রাবণ এর বন্যা ।
এরপর থেকে অনেক অভিমান, অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ, অনেক যন্ত্রণা, বুকে নিয়ে ছেলেটির নিরন্তর একাকি পথচলা … কঠিন বাস্তবতার মাঝে ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম করতে থাকে। পারে না, কারণ খাওয়া-দাওয়া, কাজকর্ম, ঘোরাঘুরি সবকিছুতেই বিউটি। কাজে মন বসে না, পড়তে মন বসে না, মায়ের স্বপ্ন পুরণ করতে হবে সেদিকেও খেয়াল নেই।ভাবনা একটাই বিউটি। এদিকে বিউটি অন্য এক পুরুষের ঘর সাজাতে ব্যস্ত। কী অদ্ভুত এক পৃথিবী! কী অদ্ভুত এক ভালোবাসা!
তারপর একদিন সব হারিয়ে বিউটি কেও ফিরে আসতে হয়েছিল ছেলেটির কাছে । সে তখন জানতে চেয়েছিল এখনো ছেলেটি আগের মতো স্বপ্ন দেখে কি না । অনেক কষ্ট অভিমান নিয়ে ছেলেটি বলেছিল “ ভালোবাসার স্বপ্নীন দিনগুলো এখন শুধু স্মৃতি তার” ।
সময়ের পরিক্রমায় ছেলেটি আর বিউটি এখন একই শহরের বসবাস । আজ যেখানে বিউটির সুখের সংসার সাঁজায়, নিঃসঙ্গ, নিঃস্তব্ধতায় ছেলেটি তখন কম্পিউটার এ কাজ করে তার জীবনের হিসাব মেলায় । এখন তার গানিতিক টেবিলের সব হিসাব ই মিলে যায় কিন্তু এই জীবনে সে কি চেয়েছে আর কি পেয়েছে তার হিসাব আর মেলে না ।
মাঝ রাতে ছেলেটির হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় । আবার মন ফিরে যেতে চায় বাঁশ বাগানে সাজানো সেই গ্রামে যেখানে তার আজন্ম লালিত স্বপ্নের বসবাস । সব মান-অভিমান ছেড়ে সে চায় তার কিশোর বেলার ভালবাসা বিউটির কে ফিরে পেতে …তার হাত ধরে নদীর ধারে হেটে যেতে। যখনি ছেলেটি স্বপ্নে ফিরে পায় তখনি কি জানি কি ভেবে ভালবাসার উত্তাপ জরানো লোনা জলে তার দু চোখ ভিজে আসে । কেন এমন হয় সে নিজেও জানে না… শুধু এটুকু ভাবে… না পেলাম প্রেয়তমা আর না পারলাম পুরণ করতে মায়ের স্বপ্ন। আমি এক স্বপ্নহারা যুবক… এই মসৃণ বালু, ইট, কাঠ এবং পাঁথরের শহর ছেড়ে তার আর কোথাও যাওয়া হবে না, কখনো না…..