কবির চিন্তাশক্তি কেউ পরিমাপ করতে পারে না, না কেউ না! কবি সৃষ্টিশীল, কবি সৃজনশীল। কবি যেমন ভাঙতে পারেন তেমন গড়তেও জানেন। ন-মণ্ডল ভূ-মণ্ডল পুরো পৃথিবীটাই কবির ঘর। তাই তিনি তাকে নিয়েই ভাবেন। চিন্তার গভীরতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে কবি হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা। পরিমণ্ডলে কোনো ঘটনা, কিংবা প্রকৃতি-পরিবেশ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সমাজ-রাষ্ট্রের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধিসহ যে কোনো বিষয় একজন কবির হৃদয়ে যে সংবেদনা তৈরি করে তা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে হয় না। ব্যক্তিজীবনের উত্থান-পতন যেমন একজন কবিকে জীবনের মর্ম অনুসন্ধান ও তার বর্ণনায় উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি সামষ্টিক বিষয়াদির ধারণ ও প্রকাশেও কবির সক্ষমতা প্রতিভাত হয়। সৃজনশীল চিন্তা কবিকে জাগিয়ে রাখে, স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশের সু-পরিচিত, দু’হাত দিয়ে যিনি লিখছেন তিনি হলেন কবি আশরাফ হাসান।
৯০’র দশকের শক্তিমান কবি আশরাফ হাসানের দুটি গ্রন্থ ‘নির্বাচিত কবিতা’ ও ‘রাইফেলগুলো প্রত্যাহার করে নাও’ এর পাঠোন্মোচন সম্পন্ন হয়। রবিবার (৩১ জুলাই-২০২২) সন্ধ্যা ৭ ঘটিকার সময় সিলেট লেখক পরিষদের উদ্যোগে ও অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির সহযোগিতায় নগরীর দরগাহ গেইটস্থ বাংলাদেশের প্রাচীন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ‘সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’র সাহিত্য আসর কক্ষে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি সফল ও স্বরনীয় দিন হিসেবে সবার হৃদয়ে স্থান করে ইতিহাস সৃষ্টি করে দিনটি।
সিলেট লেখক পরিষদের সভাপতি দেওয়ান এ. এইচ মাহমুদ রাজা চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব আহমদ মাহবুব ফেরদৌসের উপস্থাপনায় কেমুসাস তরুণ সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও ক্বারী আবদুল কাদির জীবনের মহাগ্রন্থ আলকোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি নাজমুল আনসারী।
যাদের উপস্থিতে অনুষ্ঠান বিশেষ এক মর্যাদায় উপনীত হয়েছিল, সফল হয়ছিল, ঢাকা এবং সিলেট লেখকদের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছিল, সেই সম্মানিত ব্যক্তিরা হলেন, অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট কবি ও গবেষক ড. মাহবুব হাসান, বিশেষ অতিথি ‘নতুন এক মাত্রার’ নির্বাহী সম্পাদক কবি ও গবেষক ড. ফজলুল হক তুহিন। সিলেট থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও গবেষক মুকুল চৌধুরী।
কবি আশরাফ হাসানের সাহিত্য ও কর্ম নিয়ে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক সেলিম আউয়াল, কবি আনোয়ার হোসেন মিসবাহ, কবি মামুন সুলতান, কবি আবদুল মুকিত অপি। কবি আশরাফ হাসানের ‘নির্বাচিত কবিতা’ ও ‘রাইফেলগুলো প্রত্যাহার করে নাও’ গ্রন্থ থেকে কবিতা আবৃত্তি করেন, আবৃত্তি সংগঠন ‘মুক্তাক্ষর’ এর বাচিক শিল্পী সাবর্নী গোস্বামী শুচি ও আফছানা আক্তার, খাদিজা বেগম, কবি উম্মে সুমাইয়া তাজবীন নীলা। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কবি ফয়জুল হক, মাসিক শাহজালাল সম্পাদক রুহুল ফারুক, প্রাবন্ধিক জাহেদুর রহমান চৌধুরী, কবি আব্দুল হক, মদন মোহন কলেজের প্রভাষক সালমান ফরিদ, ছড়াকার কামরুল আলম, প্রাবন্ধিক বেলাল আহমদ চৌধুরী, কবি এখলাসুর রহমান, কবি সৈয়দ রেজাউল হক প্রমুখ।
লেখক, সাংবাদিক, ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী, কবি ও সাহিত্য সংস্কৃতিকর্মীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল অনুষ্ঠানস্থল। নতুন বইর ঘ্রাণ নিতে ও কবির প্রতি ভালোবাসা দেখাতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন, স্কলারস হোম স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক কবি সুজিত রঞ্জন দাস, এড. ছায়াদ আহমদ, খলিলুর রহমান ফয়সল, ঔপন্যাসিক সিরাজুল হক, সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম চৌধুরী এহিয়া, মাহফুজুর রহমান জাহেদ, মকসুদ আহমদ লাল, কবি ছয়ফুল আলম পারুল, আব্দুল মুহিত দিদার, মঈন উদ্দিন আদর্শ মহিলা কলেজের প্রভাষক মাহবুবুর রউফ নয়ন, তাসলিমা খানম বীথি, মোহাম্মদ ইসমাইল, লুৎফা আহমদ লিলি, মাহফুজ বিল্লাহ মুরাদ, মাসুম আহমদ ইসা, আতাউর রহমান বঙ্গি, ব্যাংকার নজমুল হক চৌধুরী, শিল্পী বাহাউদ্দিন বাহার, সাজিদুর রহমান, গাজী আব্দুল কুদ্দুস শমশাদ, কুবাদ বখত চৌধুরী রুবেল, বিমান বিহারী বিশ্বাস, মিলন চৌধুরী, আশিক, নাইম আহমদ, শেলী চক্রবর্তী, নাবিল, কামাল আহমদ, শামসুল আলম, জুবের আহমদ সার্জন, হেলাল আহমদ, সাদিক হেসেন এপলু প্রমুখ।
বিশিষ্ট কবি ও গবেষক ড. মাহবুব হাসান বলেছেন, ‘কবি আশরাফ হাসান সত্য ও সুন্দরের কবি। ভালোবাসার মানুষ, ভালোবাসার কবি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ। যেখানেই রাইফেলের গুলি সেখানে আশরাফ হাসানের কবিতার বারুদ।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ”নতুন এক মাত্রা’ নির্বাহী সম্পাদক, কবি ও গবেষক ড. ফজলুল হক তুহিন বলেন, ‘কবিতার ভুবনে কবি আশরাফ হাসান নতুন কাব্য ভাষা নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। তার কিছু পঙক্তি আমাদেরকে বিপুলভাবে আন্দোলিত করে। তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।’
সভাপতির বক্তব্যে দেওয়ান এ. এইচ মাহমুদ রাজা চৌধুরী বলেন, ‘আশরাফ হাসানের কবিতার কল্পচিত্র সত্যের প্রতি অবিচল। যারা সত্যের প্রতি অবিচল থাকে তারাই পৃথিবীতে সমাদৃত হয়।’
লেখকের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি আশরাফ হাসান বলেন, ‘একজন লেখকের কাছে সারা বিশ্বটাই স্বদেশ। সারা বিশ্বের মধ্যে তারা স্বদেশকে খুঁজে বেড়ান। শেকড়ের সংযোগ আমাদেরকে সৃষ্টিশীলতায় উজ্জীবিত করে। মানুষের প্রতি কল্যাণকামীতা আর ভালোবাসার দায়বদ্ধতা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। সাহিত্যের গ্লোবাল প্লাটফরমে আমাদেরকে আসন করে নিতে হবে। তবেই আমাদের আত্মপরিচয়কে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।’
সবার বক্তব্যে উঠে আসে, কবি আশরাফ হাসান একজন সহজ সরল ও নরম প্রকৃতির মানুষ। তিনি দেশ মাটি আর মানুষের কথা ভাবেন এবং চিন্তা করেন। তার গ্রন্থে সেটাই প্রতিওমান হয়। বিদেশের মাটিতে থেকেও দেশপ্রেম সদা জাগ্রত। ইসলামিক চিন্তাশক্তি কবিকে শাণিত করে। দেশ মাটি আর মানুষের হৃদয়ে যিনি স্থান করে নিতে পেরেছেন তিনিই কবি আশরাফ হাসান।
উল্লেখ্য, কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যে পাঠক দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন আশরাফ হাসান। তার লেখা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়ায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে l আন্তর্জাতিক ইংরেজি জার্নাল ও অনলাইন প্লাটফর্মে প্রকাশিত তার ইংরেজি কবিতা স্বীকৃতি ও প্রশংসা কুড়িয়েছে l প্রবাসের ব্যস্ত জীবনের কর্মপ্রবাহের পাশাপাশি কবি সামাজিক মিডিয়াতে নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছেন।
কবি আশরাফ হাসানের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘দিগন্ত আজ বৃষ্টি ভরা’ (যৌথ কাব্য̈গ্রন্থ, ১৯৯৮), ‘দশ আকাশে একশ তারা’ (যৌথ কাব্য̈গ্রন্থ, ১৯৯৯), ‘সুরাহত সামগীত’ (২০১৪), পাখিলৌকিক জোছনা (২০১৯), রাইফেলগুলো প্রত্যাহার করে নাও’ (২০২০), নির্বাচিত কবিতা (২০২১)। এছাড়া বেশ কিছু পত্রিকা-গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন l সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ কর্তৃক তরুণ লেখক পদক ‘৯৭ লাভ করেন l
কবি আশরাফ হাসান ১৯৭৪ সালের ২২ মে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলাধীন বারকাহন গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার মরহুম মাওলানা সাইদুল হাসান ও মাতা মরহুমা লতিফুন্নেছা খাতুন। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী কবি শিক্ষকতা পেশা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। একাধিক স্কুল ও কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন l তিনি সিলেটের দৈনিক সিলেট বাণী, কাজীর বাজার, প্রভাতবেলা ও সিলেটের ডাক-এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন l এছাড়া বহুল প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাক-এ সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন l কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের আজীবন সদস্য আশরাফ হাসান বর্তমানে নিউইয়র্কে ম্যানহাটান বাংলা স্কুলের শিক্ষক, উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘গোলার্ধ’ সম্পাদক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল Channel786 ডটকম’র সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন l
তার জীবন সঙ্গিনী সৈয়দা ছামিয়া বেগম। তাদের দুই কন্যা জাকিয়া ইফফাত হাসান, জাহরা মাকছুরা হাসান ও একমাত্র পুত্র সাজেদুল হাসান তাজরিয়ান।
লেখক:
আবদুল কাদির জীবন
ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক