১৬ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ দুপুর ১:৫৭
সংবাদ শিরোনাম

মুক্তিযুদ্ধ শুনেছি আর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি

আবদুল কাদির জীবন
  • আপডেট শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ৫৯ বার পঠিত

বাংলাদেশ স্বাধীনতার আজ ৫৪ বছর। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা ও ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের সফলতা আনার পেছনে যেমন ছাত্রজনতার অবদান ছিল অনস্বীকার্য, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা (বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান) অর্জনে ছাত্র আন্দোলনের  ‍ভূমিকা প্রথম ধাপের বা প্রথম সারির। তাদের আন্দোলন অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। জুলাই-বিপ্লব-২০২৪ এর আন্দোলনে মূল ভূমিকায় ছিলো বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনবৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলন  র আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন, গণতান্ত্রিক দলসমূহ, বিভিন্ন শ্রেণির পেশা ও শ্রমজীবী মানুষ, সাধারণ ছাত্রজনতা, রেমিট্যান্স যোদ্ধারা, দেশ-বিদেশের সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টরা, নারী, শিশু ও বৃদ্ধ, বিশেষ করে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামির ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্রশিবির ও বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল। তাছাড়া সরকার বিরোধী সব সাধারণ মানুষ আন্দোলনের সাথে ছিলেন। দ্বিতীয় স্বাধীনতার ফসল কারও একার নয় বা কোনো গোষ্ঠীর একা নয়। এটা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে থাকা সাধারণ জনগণের।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি সংগ্রামী ছাত্রসংগঠনের নাম। জুলাই বিপ্লব-২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় মাইলফলক বছর হিসেবে বিবেচনা করা হয় ইতিহাসের পাতায়। শুধু বাংলাদেশে নয় সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এটি পরিচিত। বছরটি যেমন স্মৃতির পাতায় তেমনি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলন’-এর নামটিও তার সাথে স্মৃতির পাতায় অমলিন। এ সংগঠনটি বিভিন্ন স্থানে লাগাতার কর্মসূচি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করে। আমার মনে হয় এই প্রথম কোনো দেশের ছাত্ররা আন্দোলন করে সৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাল। সরকার দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। পতনের ৫ দিন আগে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি ইসলামি দলকে কিন্তু বিধি বাম এখন তারাই নিষিদ্ধ হলো। একটা কবিতার দুটি লাইন আমার সবসময় মনে পড়ে, ‘নদীর এপার ভাঙে ওপার গড়ে এই তো নদীর খেলা, সকালবেলার বাদশারে তুই ফকির সন্ধ্যাবেলা।’ আসলেই এই কবিতার লাইনের মতোই তাদের জীবন। তাদের অহংকার ও দম্ভ আল্লাহর জমিন সহ্য করতে পারে নাই তাই এই পরিণতি। অহংকার, বড়াই, বাহাদুরি, হিংসা, ক্ষমতা, শক্তি এগুলি কেবল মহান আল্লাহ তায়ালার আর কারোর নয়। আসলে উপর ওয়ালার খেলা বুঝা দায়। কখন জানি কী হয় বুঝা মুশকিল।

শেখ হাসিনার পতন এটা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের অবিশ্বাস্য সাফল্য। মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারির এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘অন্ধকারে ভয় পেও না, আলো আছে আড়ালে, বিপদ তোমার কেটে যাবে, তুমি ওঠে দাঁড়ালে।’ ছাত্ররা সাহস আর শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ফলে সৈরাচার দেশ থেকে পালিয়েছে। আমরা পেয়েছি নতুন একটি বাংলাদেশ।

জুলাই মাসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ডাকে ঢাকা কেন্দ্রিক আন্দোলন শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে ঢাকা, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল সব বিভাগ শহর ও জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে গণপরিবহন বন্ধ, রাস্তাঘাট অবরোধ এবং পরবর্তীতে দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। আলোড়ন তৈরি করে সারাদেশে। যোগ দেয় দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। এছাড়া সকল সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও রাজপথে দেখা গেছে। স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। আহত ও নিহতদের সংখ্যার মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আন্দোলন রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে। পুলিশ নির্বিচারে শুরু করে টিয়ার গ্যাস, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, ফাঁকা গুলি, সরাসরি গুলি। ছাত্ররা এসব তোয়াক্কা না-করে ইট পাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে চতুর্দিকে। শুরু হয় তুমুল লড়াই। পুলিশের গুলিতে মারা যায় শত শত ছাত্র-আন্দোলনকারীরা। ভয় না-পেয়ে আর শক্তিশালী ভূমিকায় সংগঠিত হয় ছাত্ররা। প্রথমদিকে ঢাকা কেন্দ্রিক মারামারি হলেও পরবর্তীতে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনে যোগ দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, ডাক্তার, আইনজীবী, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। আমার জীবনে এই প্রথম দেখা কোনো ছাত্র পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বুক পাতিয়ে দিতে। তার নাম আবু সাঈদ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আন্দোলন যেন আগুনের ন্যায় শীসাঢালা প্রাচীরের মতো আরও বেগবান হয়ে গেছে। তার মৃত্যুর পর কেটে গেছে ভয়, বাড়িয়ে গিয়েছে সাহস আর শক্তি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপোসহীন আন্দোলন এটা আমাকে আরও সাহসী করে তুলেছে। তারপর…

শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন। ফেটে পড়ে সাধারণ জনগণ। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে, ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ ‘চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’ স্লোগান দিতে থাকে। তারপর স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইউনিভার্সিটিসহ সারাদেশে এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক বাধা, গুলি করে ছাত্রদের হত্যা, চাকরিতে বৈষম্য, মত প্রকাশে বাধা ইত্যাদি অনিয়ম দেখতে দেখতে আর সহ্য হচ্ছিল না। তারপর ভাবলাম, এই আন্দোলনে যোগ দিতে হবে। স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়ে সমতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আন্দোলন যখন ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক তখন সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মাঠে নেমেছে।

আমি সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। আমাদের ডিপার্টমেন্টের কো-কারিকোলাম অ্যাক্টিভিটিজ বা সামাজিক বিভিন্ন গ্রুপ আছে। এরকম একটা গ্রুপে নিয়মিত আন্দোলন সংগ্রামের মেসেজ আসত। এই মেসেজ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই এবং পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেই মাঠে থাকার। আম্বরখানা একটা ম্যাচে থাকি। ম্যাচের অনেক ছেলেরা এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে। তারপর আমরা একসাথে সব আন্দোলনে যোগ দেই। আমি যখন মেসেজে পেতাম সাথে সাথে নাহিদ ভাইকে বলতাম। নাহিদ ভাই শোনার সাথে সাথে বলতেন এ আন্দোলনে যোগ দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এখানে আমাদের থাকতে হবে। এখন আমাদের ঘরে বসে থাকার সময় নয়, মাঠে থাকার সময়। প্রথমদিন আমরা সিলেটের আখালিয়াতে যোগ দেই। যাওয়ার পরে দেখলাম শত শত ছাত্রছাত্রী রাস্তা ব্লক করে ‘আমার ভাই মরল কেন, খুনি হাসিনা জবাব দে’ মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত সারা এলাকা। কিছুক্ষণ পরে পুলিশের গুলি। আমরা আস্তে আস্তে পেছনে হাঁটা শুরু করে মাউন্ট এডোরা হসপিটালে ঢুকে পড়ি। আমাদের সাথে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার লায়েক আহমদ, নাঈম, হাসান, আহম্মদ, মাসুম, সুমন আহমেদ রিফাত ও তানভীর ছিল। আমি ভাবছিলাম, পুলিশ হয়তো হাসপাতালে এসে আমাদেরকে আক্রমণ করবে। পরে দেখি না-তারা হাসপাতালের সামন থেকে চলে যায়। প্রথমদিন আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। আমি যে-দিন আন্দোলনে যেতাম কামরুল আলম ভাইকে ফোন দিয়ে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ শোনাতাম। এটা মনে করে যে, পরিচিত কেউ একজন আমি কোথায় আছি জানলে, যদি আমার কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে আমার পরিবার জানতে পারবে। একদিন আমাদেরকে পুলিশ মাউন্ট এডোরা হসপিটালের ঘেরাও করে রেখেছে। কামরুল ভাইকে বললামÑকী করব এখন, তিনি বললেন, কৌশলে সরে আসতে। পুলিশ যখন সরে যায় ঠিক তখন আমরা আবার রাস্তায় নেমে আন্দোলন করি। বিকাল ৩টা থেকে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত থেমে থেম আন্দোলন চলত। হাজার হাজার মানুষ দু-পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলি। তারা তাদের ঘৃণা প্রকাশ করত। কত মা এমন দৃশ্য দেখে আল্লাহর কাছে সরকার পতনের জন্য দোয়া করত। এলাকাবাসী ছাত্রদের অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কেউ পানি দিয়েছে, কেউ খাবার দিয়েছে, কেউ তাদের ঘরে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ দিয়েছে। এই স্মৃতি ভুলে যাবার নয়।

সিলেট নগরীর অবস্থা ছিল ভয়াবহ। কোনো স্থানে দাঁড়ানোর সাথে সাথে পুলিশ গুলি করে দিত। মদিনা মার্কেটে শত শত পুলিশ। কিছু পুলিশকে পুলিশ মনে হতো বাকিরা সবাই ছাত্রলীগের ছেলেদের পোশাক পরিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে এমনটা মনে হতো। অনেক পুলিশকে ইন্ডিয়ান পুলিশের মতো দেখতে লাগত। একদিন আমাদেরকে পুলিশ গুলি করতে গিয়ে পরে যায় একজন ছোটো বাচ্চার চোখে। অনেক কষ্ট ও ব্যথা অনুভব করেছিলাম সেদিন। এখন একটু অনুভব করেন পুলিশের গুলি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। মানুষের ঘরে গিয়ে লুকিয়েও আমরা শান্তি পেতাম না গুলি করে দিত। সেই দৃশ্য নিশ্চয়ই সিলেটবাসী দেখেছে। সিলেট আখালিয়া কেন্দ্রিক সংঘর্ষের সময় আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দৌড়ে আশ্রয় নিতাম বিভিন্ন বাড়িতে। একজন মহিলার কথা না-বললেই না-হয়। লিপি বেগম। একজন সমাজকর্মী ও লেখক। সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকেন। মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। সেটাই পেয়েছি জুলাই বিপ্লবে। যখনই দৌড়ে কোনো বাড়ির আশ্রয় খুঁজতাম, তখনই লিপি আপাকে ফোন দিয়ে বাসায় যেতাম। চৌহাট্টা কর্মসূচি পালনকালে লিপি আপার সাথে সাক্ষাৎ। তাছাড়া দেখা হয় নাঈমুল ইসলাম গুলজার, কবির আশরাফ ভাই, নাহিদ, নাঈম, লায়েক আহমদ, তানভীর, হাসান অনেকের সাথে। আন্দোলনের কোনো নিউজ বা ছবি কিছুই ফেইসবুকে পোস্ট করতাম না। আমার সেইফটির জন্য। অনেক সিনিয়র ভাই পরামর্শ দিয়েছিলেন ফেইসবুকে পোস্ট না-করার জন্য।

৫ আগস্টের দিন বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করে ফেইসবুকে পোস্ট দেই। তারপর ৬ আগস্টে মাহমুদুর রহমান সম্পাদিত আমারদেশ পত্রিকা আবার পড়তে চাই শিরোনাম একটা পোস্ট দেই ফেইসবুকে। বিএনপির একজন কর্মী নেগেটিভ মন্তব্য করলেও তার উত্তরে কামরুল আলম লিখেছেন, ‘পুলিশের গুলির মুখ থেকে জীবন ফোন করার পর পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছিলাম। বেঁচে ফিরতে পারবে কী না সন্দেহের মধ্যে ছিলাম। স্ট্যাটাস দিয়ে সরকার পতন সম্ভব না। স্ট্যাটাস দিয়ে আন্দোলনে যাওয়া সমীচীন ছিল না। কর্মের মধ্যেই প্রমাণ। আমি সাক্ষি দিচ্ছি জীবন এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।’ আমি আজ আনন্দিত যে, এরকম একটা যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধ শুনেছি আর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। নতুন বাংলাদেশ হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরে সংস্কার করে বৈষম্যহীন একটা রাষ্ট্র চাই। তখনই যারা এ আন্দোলনে আত্মত্যাগ করেছে তাদের আত্মা শান্তি লাভ করবে।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন মূলত সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের গেটে প্রথমদিকে শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে সিলেট মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে যেমন- আখালিয়া (মাউন্ট এডোরা হসপিটালের সামনে), মদিনা মার্কেটের সামন, সুবিদবাজার, আম্বরখানা, চৌহাট্টা পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, নয়াসড়ক, জেল রোড, এমসি কলেজের সামনে, রেজিস্ট্রারি মাঠ, করিমউল্লাহ মার্কেটের সামনে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উল্লিখিত স্থানে আন্দোলন হলেও মূলত আন্দোলন হয়েছে শাবি গেট, আখালি মদিনা মার্কেট ও চৌহাট্টা। ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ছাত্র-পুলিশ-ছাত্রলীগ ত্রিমুখী সংঘর্ষ বাঁধে। রক্তের বন্যা বয়ে যায় সারা শহরে। সংঘর্ষে নিহত হন অনেক। তাছাড়া শত শত ছাত্রছাত্রীরা আহত হয়। যে-বাবা-মা তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন, তাঁরা কী কোনোদিন তাদের সন্তানকে ফিরে পাবেন? যারা আহত হয়েছেন, বিশেষ করে যাঁরা চোখ হারিয়েছেন, হাত হারিয়েছেন, পা হারিয়েছেন, বা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তারা কী আর কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন?

আওয়ামী লীগ সরকার মানুষকে দমন করতে চেয়েছিল গুলি করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুক পেতে দিয়েছেন। স্লোগান উঠেছিল, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার আর টিকতে পারেনি। সেনাবাহিনীও ছাত্রজনতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকার করে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়।

হায়দার হোসেনের একটি গান ব্যাপক জনপ্রিয়। একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে যাঁরা কাজ করতেন তাদের কণ্ঠে গানটি প্রায় শোনা যায়। যে-গানটির কথা বলছি, তার মধ্যে একটি লাইন হলো- ‘তিরিশ বছর পরও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।’ আজ বাংলাদেশের ৫৪ বছর। প্রথম জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে এসে বলা যায় ‘চুয়ান্ন বছর পরও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি। দুশো বছর পরেও যে-এ লাইনটি বলবে না তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারবে?

স্বাধীন একটা রাষ্ট্র বাংলাদেশ। জাতিসংঘে রয়েছে সদস্যপদ। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং এ ভাষায় আমরা কথা বলি। এ দেশে যে-সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন, তারাও স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ভাষার চর্চা করতে পারেন। নিজস্ব পতাকা রয়েছে। এমনকি এ দেশের নাগরিকেরা নিজস্ব পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিশে^র বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে পারেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যাঁরা আমাদের দেশ পরিচালনা করেছেন, তারা এ দেশের। ছোটো থেকে বড়ো হচ্ছি, পড়াশোনা করেছি, মেধার বিকাশ ঘটেছে। ‘স্বাধীনতা’ এ শব্দটির মর্মার্থ কী শুধু নিজস্ব পতাকা, একটি সুনির্দিষ্ট ভুখন্ড, স্বতন্ত্র পাসপোর্ট বা নিজস্ব সরকার ব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ? সেটা আজ বুঝতে পারছি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত প্রায় ৫৪ বছর পরও স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ থেকে আমরা আজ বহুদূরে!

গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান উপাদান হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। গণতান্ত্রিক দেশগুলিয় ভোটের অধিকার হচ্ছে একজন মানুষের প্রধান রাজনৈতিক অধিকার ও ভোটাধিকার প্রয়োগ। অথচ গত দু-টার্ম নির্বাচনে আমরা ভোট দিতে পারিনি। ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই আমাদের ভোট কে বা কারা ভোট দিয়ে দিত। এই সংস্কৃতি আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা চাই সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত হোক। রক্তাক্তের পরিবর্তে সুন্দর, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথ ফিরে আসুক।

স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত শহিদ নূর হোসেনের একটি ছবি এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে ছিল অনুপ্রেরণার। নূর হোসেনের বুকে ও পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ আজকের বাংলাদেশে আবু সাঈদ ও মুগ্ধের মতো যারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলনকে বিভিন্নভাবে উজ্জীবিত করেছেন, তাদের প্রত্যেকে একেকজন নূর হোসেন। আজকে এ আন্দোলনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন বা যারা আহত হয়েছেন, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের কথা ভেবে আমাদের অন্তর কেঁদে উঠছে। এমনকি যে-পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, তার সন্তানের কথা ভেবেও আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে হয়তো বা এত স্বল্পসময়ে এত অধিক সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর নজির আছে বলে আমার জানা নেই।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে হয়-
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান : জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্ত‚প-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবে তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

আমার আমাদের দেশ প্রিয় বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভ‚মি, প্রিয় মাতৃভ‚মিকে অনেক ভালোবাসি। কবির ভাষায় সকল জঞ্জাল সরিয়ে এই দেশ হোক শিশুদের, সাধারণ জনগণের বাসযোগ্য বাসস্থান। আর যেন কোনো প্রাণী আমাদের ক্ষতি করতে না-পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এখন সময় এসেছে আমাদের সবার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে, বিবেক ও নীতি-নৈতিকতার সমন্বয়ে আমাদের সবাইকে উদ্ভাসিত হতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বত্র জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দেশের জনগণ যাতে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না-হন সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষানীতি, সমাজনীতি ও দুর্নীতিগ্রস্ত সব সেক্টর সংস্কার প্রয়োজন। একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে। ঢাকার অভিজাত এলাকার সন্তান যে-ধরনের শিক্ষা ও সুযোগ সুবিধা লাভ করে, গ্রামের একজন সন্তানও যাতে ওই একইরকম শিক্ষা, ও সুযোগ সুবিধা পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের প্রতিটি স্তরে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। পুরো রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। সবকিছুকে ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ না-রেখে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। জানি, সবকিছু একদিনে অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের ধীরগতিতে ক্রমাগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে। তাহলেই জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এর আন্দোলন সফলতা লাভ করবে।

সময় টিভির (২২ ডিসেম্বর ২০২৪) রিপোর্ট অনুযায়ী ও গণঅভ্যুত্থান বিশেষ সেলের দলনেতা অতিরিক্ত সচিব খন্দকার জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংবাদের ভিত্তিতে জুলাই বিপ্লব ২০২৪ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল। তালিকায় রয়েছে সিলেট বিভাগের ৩১ জন শহিদের নাম। এরমধ্যে সিলেট জেলার ১৩, হবিগঞ্জের ১৫ ও সুনামগঞ্জের ৩ জন রয়েছেন। সিলেট জেলার শহিদরা হলেনÑ সানি আহমেদ, মো. নাজমুল ইসলাম, হোস উদ্দিন, মিনহাজ আহমদ, মো. পাবেল আহমদ কামরুল, জয় আহমেদ, তারেক আহমদ, তাজউদ্দিন, আবু তাহের মো. তুরাব, সুহেল আহমেদ, মো. মোস্তাক আহমেদ, ওয়াসিম ও মঈনুল ইসলাম। সুনামগঞ্জ জেলার শহিদেরা হলেনÑ মো. আয়াত উল্ল্যাহ, হৃদয় মিয়া ও সোহাগ মিয়া। হবিগঞ্জ জেলার শহিদেরা হলেনÑ হোসাইন মিয়া, মো. আশরাফুল আলম, মো. মোজাক্কির মিয়া, শেখ নয়ন হোসাইন, মো. তোফাজ্জল হোসাইন, মো. সাদিকুর রহমান, আকিনুর রহমান, সোহেল আকঞ্জী, আজমু আলি, শেখ মো. শফিকুল ইসলাম, মামুন আহমদ রাফসান, মুনাঈল আহমদ ইমরান, রিপন চন্দ্র শীল, করিমুল ইসলাম ও মো. আনাস মিয়া। জুলাই-আগস্টের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে প্রতিপক্ষের আক্রমণে শহিদ বা আহত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের নামের তালিকা চুড়ান্তকরণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ৬৪ টি জেলায় গঠিত কমিটি কাজ করছে।

বাংলাদেশের সাধারণ ছাত্রজনতা প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলন হলো- বৈষম্য, অসঙ্গতি, বাক্-স্বাধীনতা হরণ ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এক মহাবিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকৃত সব নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী বা বিভিন্নভাবে যারা সহোযোগিতা ও উজ্জীবিত করেছেন, যারা আমাদের এ সুন্দর পথের সন্ধান দিয়েছেন। তাদের দেয়া এ সুন্দর পথ ধরে অনেকদূর এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সে প্রত্যাশা আমাদের সবার…

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2025 AkashBangla. Developed by PAPRHIHOST
Theme Dwonload From Ashraftech.Com
ThemesBazar-Jowfhowo