১৬ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ রাত ৪:৫৯
সংবাদ শিরোনাম

প্রতিবন্ধী শিশুরা সমাজের বোঝা নয় : আবদুল কাদির জীবন

আবদুল কাদির জীবন
  • আপডেট শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ১০০ বার পঠিত

সমাজে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে পৃথক পৃথক সত্ত্বা বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ গুণাগুণ, দোষ-ক্রটি ছাড়া বাহ্যিকভাবেও রয়েছে অনেক পার্থক্য। মানুষের মধ্যে রয়েছে লম্বা-খাটো, সাদা-কালো। আবার অনেকেই আছেন যাদের কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারওবা দৃষ্টি শক্তি নেই। আবার অনেকে কানে শোনে না কথাও বলতে পারে না। সমাজে এসব মানুষ হলো ব্যতিক্রম। এদেরকে সাধারণভাবে প্রতিবন্ধী বলা হয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও’র) মতে ‘একজন প্রতিবন্ধী হলেন যার স্বীকৃত শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিগ্রস্ততার দরুন যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা কমে যায়।’ জাতিসংঘের প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী প্রতিবন্ধীতা হলো এমন কোনো বাঁধা বা সীমাবদ্ধতা যা একজন মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে পূর্ণভাবে ব্যাহত করে। কতিপয় প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তি যদি সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার বা স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাঁধার সম্মুখীন হয় তাহলে তাকে প্রতিবন্ধী বলা হয়। মোট কথা, বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আর দশজন যে কাজগুলো করতে পারে অসামর্থ্যরে কারণে সে কাজগুলো প্রাত্যহিক জীবনে করতে না পারার অবস্থাই হলো প্রতিবন্ধীতা।

পত্র-পত্রিকা পড়লে আমরা দেখতে পাই, প্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুদের নিয়ে এখন সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘও এখন এ বিষয়ে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এসব শিশুদের নিয়ে। এই শিশুরা যেন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে পারে সে ব্যবস্থা করছে সরকার। সরকারের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এগিয়ে আসছে।

আমরা প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা করতে পারি, শিক্ষা ও স্নেহ-ভালোবাসা দেখাতে পারি, ইতিবাচক দৃষ্টি রাখতে পারি, সেবাযত্ন করতে পারি, তাদেরকে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারি, তারা যে ভালো কাজের প্রতি আগ্রহী সে কাজে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারি তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে দিতে পারি, তাহলে তাদের নিয়ে আমাদের যে চিন্তা, উদগ্রীব, উৎকণ্ঠা থাকে তা অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করলে তারাও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। প্রতিবন্ধী শিশুরা যে আমাদের জন্য বোঝা নয় সম্পদ হতে পারে তা বিভিন্ন দেশে যেমন উদাহরণ আছে ঠিক তেমনি আমাদের লাল সবুজের দেশে অহরহ প্রমাণ আছে।

একটা সময় ছিল যখন প্রতিবন্ধি শিশুদের নিয়ে পরিবার এবং সমাজ অনেক চিন্তিত থাকতো এখন আর তেমনটা নেই। কারণ, এখন বাংলাদেশ সরকার সারা দেশব্যাপী প্রতিবন্ধি ইনস্টিটিউট তৈরি করেছে, তাদেরকে প্রতিমাসে ভাতা দেয়া হচ্ছে, তাদেরকে সরকারিভাবে ফ্রি প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে যাতে তারা কর্ম করে খেতে পারে, এছাড়া সরকার তাদের সমস্যা চিহ্নিত করে সেই আলোকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আমরা মানুষ বড়ই অদ্ভুত। কারো ভালো কাজের প্রশংসা করতে পারি না। আবার নিজেও ভালো কাজ করতে পারি না। সরকারের পাশাপাশি একটি পরিবারের সদস্যরা যদি প্রতিবন্ধি শিশুর সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতো তাহলে আমি মনে করি স্টিফেন হকিং ও তামান্না আক্তারের মতো প্রতিটি প্রতিবন্ধি সফল হতো। তারা তাদের জীবনকে ভালোভাবে উপভোগ করতো। কিন্তু না, আমরা আমাদের প্রতিবন্ধি শিশুদের নিয়ে ঘরে বসে থাকি, তার সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করার ব্যবস্থা করি না, তাকে পড়াশোনা করতে দেই না, তাকে সারাদিন একঘরে রেখে তার মন-মানসিকতা নষ্ট করে দেই। আর মনে মনে সরকারকে দোষারোপ করি, আল্লাহকে গালি দেই। আমাদের স্বভাব আমরা পরের উপর নির্ভরশীল। আমরা মনে করি কেউ যদি আমাকে ভাত মুখে তুলে দিত কতই না ভালো হতো আমার কাজ যে আমাকেই করতে হবে সেটা আমাদের চিন্তা চেতনায় আসে না।

বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম ‘অটিস্টিক চিলড্রেন ডেভেলপমেন্ট স্কুল এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, চট্টগ্রাম ‘অটিস্টিক চিলড্রেন ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন স্কুল, অটিস্টিক চিলড্রেন ডেভেলপমেন্ট স্কুল এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার অন্যতম। তাছাড়া সিলেট শাহজালাল রাগীব-বাবেয়া প্রতিবন্ধী ইনস্টিটিউট প্রতিবন্ধি শিশুদের নিয়ে কাজ করছে ২০১৪ সাল থেকে। তাদের স্লোগান হলো “Disability is not inability”। তারা প্রতিবন্ধি শিশুদের যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি, শিক্ষণ প্রতিবন্ধিতা, মনোযোগ বিকৃতি, অতিরিক্ত অস্থির-চঞ্চল শিশু, বদমেজাজি শিশু, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলো নয় এরকম দেশে আরো শত শত প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধি শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। আমি হলফ করে বলতে পারি এই প্রতিবন্ধি শিশুরা নতুন একটি জীবন পাবে, তারা সাবালক হওয়ার পরে কর্ম করে খেতে পারবে, তাদের বড় বড় সমস্যাগুলো সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। কারণ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এই শিশুরা এখান থেকে শিখছে কিভাবে তারা তাদের সমস্যা জয় করে নিজের উন্নতি করবে। নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাবে।
সমাজে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান অত্যন্ত অবহেলিত। পরিবার থেকে শুরু করে সব স্থানেই প্রতিবন্ধীদেরকে খাটো করে দেখা হয়। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো প্রতিবন্ধীদের সামাজিক সব অধিকার ভোগ করার কথা থাকলেও বরাবরই তারা তা থেকে বঞ্চিত। আত্মীয়-স্বজন সামাজিক মান মর্যাদার ভয়ে তাদের সরিয়ে রাখেন। সমাজে তাদের অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থান, বিয়ে, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হয়। বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের শিকার হয়ে তারা সমাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। যেকোনো মানুষের সামাজিক অবস্থান তৈরি হয় পরিবার থেকেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একথা আরো বেশি প্রযোজ্য।

আমাদের দেশের প্রতিবন্ধীরা কোনো না কোনোভাবে পরিবারে অবহেলার শিকার। তবে কোনো পরিবারে বেশি, কোনো পরিবারে কম। অবহেলার কারণে প্রতিবন্ধীতাকে অভিশাপ মেনে নিয়ে তারা অবহেলিত বঞ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য হয়। দরিদ্র পরিবারগুলোতে প্রতিবন্ধীদের অবস্থা আরো করুণ। অনেক সময় তাদের অনাহার অর্ধাহারে থেকে দিন পার করতে হয়। অধিকাংশ পরিবারেই প্রতিবন্ধীদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যেখানে সমস্যা আছে সেখানে সমাধান আছে। যেখানে প্রশ্ন সৃষ্টি হয় সেখানে উত্তরও তৈরী হয়। আমরা যদি আমাদের সমস্যা নিয়ে বসে থাকি তাহলে এই সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে। পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয় তার দুটি দিক থাকে। ভালো এবং মন্দ, পজিটিভ এবং নেগেটিভ, সুন্দর এবং অসুন্দর, শক্তিশালী এবং দুর্বল, বড় এবং ছোট।
প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে অবহেলায় পিছনে ফেলে রেখে সমাজ এগিয়ে যাবে তা কখনই সম্ভব নয়। সমাজের অংশ হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করলে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয় বরং সম্পদে পরিণত হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ২০১৮’ সালে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, প্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুরা সমাজের বোঝা নয়। এদের সুপ্ত প্রতিভা আছে। তাদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারলে তারা আমাদের সম্পদ হবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে সুস্থরা পারে না, কিন্তু প্রতিবন্ধীরা আমাদের অলিম্পিকের স্বর্ণ এনে দেয়। তাই তারা আমাদের সম্পদ। তাদের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের কাজ।’

নবী করিম (সা.) প্রতিবন্ধীদের ভালোবাসতেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকুম (রা.)-কে তিনি ভালোবাসতেন ও খোঁজখবর নিতেন। মহানবী (সা.) একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবিকে দুবার মদিনার সাময়িক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা নবী করিম (সা.)-এর অনুপম আদর্শ। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের প্রতি অবহেলা নয়, ভালোবাসা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিবো।

পরিশেষে বলতে চাই, প্রতিবন্ধী শিশুরা অন্য গ্রহের কোন প্রাণী নয়, তারা এই সমাজের সাধারণ শিশুর মতো তারাও জন্মগ্রহণ করেছে। তাদেরকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নাই। তাদেরকে যদি আমরা সঠিকভাবে, উপযুক্ত সময়ে পরিচর্যা করতে পারি তাহলে তারাও তাদের স্বপ্নকে পূরণ করতে পারবে। পরিবারের জন্য, দেশের জন্য, সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। তখন তারা সমাজের বা দেশের বোঝা হবে না বরং সম্পদ হবে।**

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2025 AkashBangla. Developed by PAPRHIHOST
Theme Dwonload From Ashraftech.Com
ThemesBazar-Jowfhowo