দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী ছিলেন শেষ জমিদার। তিনি শুধু জমিদারী নিয়েই ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সমাজ সচেতন। পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যের ধারাকে তিনি সমুন্নত রাখেন। তাঁর দয়া ও দানশীলতার কথা এলাকাবাসী আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রজাসাধারণ কখনই তার ক্ষমতার রোসানলে পড়েনি। উপরন্তু তার সর্বজনীন মানবতাবাদী আচরণের মাধমের সাধারণ মানুষের প্রিয়ভাজন হন তিনি। তার ফলশ্রুতিতে পকিস্তান আমলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি প্রত্যাখ্যাত হননি। জমিদারী প্রথা বিলোপের পর অনেক অত্যাচারী জমিদারকেই নিগৃহীত হতে হয়েছে। সমাজ সংস্কারক হিসেবে তার খ্যাতি এ অঞ্চলে সর্বজনবিদিত। তিনি একাধিক হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মক্তব নির্মাণ করেছেন।
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী পরিবারের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেসের রাজনীতি ও মুসলিমলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। তাছাড়া দেশ স্বাধীনতার মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিলো এ পরিবারের অবদান। স্বাধীনতা-উত্তর থেকে অধ্যবদি পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন এ পরিবারের ব্যক্তিবর্গ।
শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক এ জমিদার অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তারমধ্যে পানাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পানাইল রাজ বাড়ি জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা উল্লেখযোগ্য। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মানুরাগী। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে তিনি অকৃপণভাবে অনুদান দিতেন। এ ছাড়াও তার জীবদ্দশায় তিনি আরো অনেকগুলো মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী ছিলেন এই বংশের সর্বাপেক্ষা দানশীল ব্যক্তি। সাধারণভাবে জমিদার বলতেই সাধারণ মানুষের মনে যে, নেতিবাচক প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, রউফুর রাজা চৌধুরী সে ধরনের জমিদার ছিলেন না। প্রজাহিতৈসী এ জমিদার তার কাজের মাধ্যমে নিজেকে একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দয়া ও দানশীলতাই ছিল তার চারিত্রীক বৈশিষ্ট্য। জন কল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি অনেক জমি ওয়াকফ করে যান।
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী পিতা মরহুম দেওয়ান ছনুবর রাজা চৌধুরী ও মাতা মরহুমা বেগম জমিলা খাতুন চৌধূরানীর ঘর আলোকিত করে ১৩১৬ বাংলা সনের ১০ বৈশাখ মোতাবেক ১৯০৮ ইংরেজি সালে বাংলাদেশের সুপরিচিত আধ্যাতিক নগরী, হযরত শাহজালাল ও শাহপরানের পূণ্যভুমি সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের পানাইল গ্রামের মুসলিম রাজ পরিবারে (বংশে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৩ তম মুসলিম বংশের রাজা (শেষ জমিদার) দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী।
দোহালিয়া রাজ বংশের প্রথম রাজা ছিলেন রাজা শ্রীমন্ত রায়, রাজা শ্রীমন্ত রায়ের পূর্ব পুরুষ ভারতের রাজস্থানে (রাজপতানা) দক্ষিণ রাঢ় অঞ্চল হতে প্রথমে জসোর জেলায় আলফাডাঙা থানায় পানাইল গ্রামে বস্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে নবীগঞ্জ সিনান ঘাট গ্রামে, পরে জলশ্রী গ্রামে, তারপর রাজনপুর গ্রামে অবস্থান করেন। তার পরবর্তীতে দোহালিয়া পানাইল অবস্থান করেন। রাজা শ্রীমন্ত রায়ের অষ্টম বংশধর রাজা প্রেম নারায়ণ রায়, ১১০৫ বাংলায় প্রথম ইসলামধর্মে দীক্ষিত হয়ে রাজা মোহাম্মদ ইসলাম নাম ধারন করেন। রাজা মোহাম্মদ ইসলাম তিনি দোহালিয়া একটি খারিজি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসায় উর্দু ফারসি সম্মেলিত একটি লাইব্রেরী ছিলো নবম বংশধর রাজা মোহাম্মদ মাসুম মুর্শিদাবাদ (বাংলা বিহার উরিষ্যার রাজধানী) নবাব আলীবর্দী খাঁন সঙ্গে পড়তেন। ফারসিতে সর্বউচ্চ পদ মুল্লা পাশ করার পরে নবাব আলীবর্দি খাঁ রাজা মোহাম্মদ মাসুমকে দোহালিয়া পরগণা দেওয়ান (চিপ রেভিনিউ কালেক্টর) নিযুক্ত করেন।
রাজা শ্রীমন্ত রায় তাঁরই অধস্তন পুরুষ রাজা নরোত্তম রায়ের ছেলে রাজা পুরুষোত্তম রায় সম্রাট আকবরের প্রশাসনের মনসবদার, বকশিগিরি পরে পেশকার পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তাঁর ছেলে রাজা পৃথ্বীধর রায় সাবেক ছাতক বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার থানার (দোহালিয়া পরগণা) ও হবিগঞ্জ মহকুমার পুটিজুরি পরগনা জমিদার ও চৌধুরী নিযুক্ত হন। রাজা পৃথ্বীধর রায়ের অধস্তন রাজা জিতান্মৃত রায়। জিতান্মৃত রায়ের দুই ছেলে -১. রাজা সিংহ রায় ও ২. রাজা শিবচন্দ্র রায়। রাজা শিবচন্দ্র রায়ের তিন ছেলে -১. রাজা ধর্ম নারায়ণ ২. রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ ৩. রাজা যশোমন্ত রায়। রাজা যশোমন্ত রায়ের তিন উত্তরসূরী -১. রাজা মোহাম্মদ মাসুম ২. রাজা মোহাম্মদ বাছির ৩. রাজা মোহাম্মদ নাছির (নিঃসন্তান)। রাজা মোহাম্মদ বাছিরের তিন উত্তরসূরী -১. রাজা মোহাম্মদ আলোওয়ার ২. মোহাম্মদ আশরফ ৩. মোহাম্মদ আনছর। রাজা মোহাম্মদ আলোওয়ারের ছেলে মনসুর রাজা। মনসুর রাজার চার উত্তরসূরী -১. সুরুজ ২. ফিরুজ ও ৩. দেওয়ান ছনুবর রাজা চৌধুরী ৪. মাসহুদ।
দেওয়ান ছনুবর রাজা চৌধুরীর দুই ছেলে ১. দেওয়ান রইছুর রাজা চৌধুরী ২. রউফুর রাজা চৌধুরী। রইছুর রাজা চৌধুরীর তিন ছেলে-১. রফিকুর রাজা ২. আতিকুর রাজা ৩. মনসুর রাজা। রউফুর রাজা চৌধুরীর ছয় ছেলে-১. মুহিবুর রাজা ২. মুফিদ রাজা ৩. মসহুদ রাজা ৪. মকছুদ রাজা ৫. মাহবুব রাজা ৬. মাকুল রাজা। মুফিদ রাজা চৌধুরীর ( লেখক, গবেষক ও কবি) রচিত ১৮টি পান্ডুলিপি এর মধ্যে ৪টি প্রকাশিত এবং বাকিগুলো অপ্রকাশিত। তিনির এক ছেলে – দেওয়ান এ এইচ মাহমুদ রাজা চৌধুরী।
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী তাঁরা দুই (২) ভাই ও পাঁচ (৫) বোন। বিমাতা মোছাম্মত জমিলা খাতুনের ঔরশে জন্ম হয় তিন (৩) বোনের। মোট আট (৮) বোন। ভাইদের মধ্যে-১. দেওয়ান রইছুর রাজা চৌধুরী ও ২. দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী। ৮ বোনদের মধ্যে-১. দুরদ পিন্দা বানু ওরফে কিনা বিবি ২. ফরখুন্দ বানু ওরফে সাদা বিবি ৩. ফাহমিদা বানু ওরফে কুটু বিবি ৪. ফরিদা খাতুন বানু ওরফে ছাবু বিবি ৫. ছামছুন্নেছা খাতুন ওরফে খই বিবি ৬. জাহেদা খাতুম ওরফে বড় বিবি ৭. নবিদা খাতুন ওরফে কটই বিবি ৮. নাম অজানা ওরফে মনই বিবি। তার সুযোগ্য উত্তরসুরীরা হয়তো জমিদারির উত্তোরাধিকার হতে পারেননি, কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্যকে ঠিকই ধরে রেখেছেন। তাদের আচার আচরণের নম্রতা, ভদ্রতা ও শালীনতা পরিবারটির প্রতি আজো সবার আগ্রহকে ধরে রেখেছে।
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরীর পিতা দেওয়ান ছনুবুররাজা চৌধুরী। দেওয়ান ছনুবুররাজা চৌধুরী ছিলেন ইংরেজ আমলে সিলেটের গ্রামীণ জনপদে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক। ব্রিটিশ আমলে উত্তরপূর্ব আসাম অঞ্চলসহ বৃহত্তর সিলেটের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যে ক’জন রাজনৈতিক বেতা ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন দেওয়ান ছনুবুর রাজা তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন অগ্রগণ্য। ১৮৭৪ সালে সিলেট বিভাগকে পৃথক করায় তিনি চাকরি ছেড়ে পৃথীমপাশা জমিদার আলি আমজাদের পিতা ও সিলেটের অন্যন্য হিন্দু মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নিয়ে কলকাতার গভর্নর নর্থ ভ্রুকে সিলেটে এনে সংবর্ধনা দিয়ে সিলেট বাসির বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইকোর্টের ব্যবস্থা করেন। তাঁর আদর্শিক পথ ও জাতীয়তাবাদের চিন্তার ফসল স্বরুপ ‘দোহালিয়া এমই বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ বিদ্যালয়টি ছিল ব্রিটিশ আমলে গ্রামীণ জনপদের ইংরেজী মাধ্যম এক অনন্য বিদ্যানিকেতন। এ বিদ্যালয়টি প্রথমে মধ্যমঙ্গ ও পরে উচ্চ মধ্যমঙ্গ বিদ্যালয় উপনিত হয়। এখানে পড়াশোনা করে পরবর্তী সময়কালে বৃহত্তর সিলেটের বহু গুনীজন স্ব স্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। দেশের খ্যাতনামা দার্শনিক ও জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মকবুল হোসেন চৌধুরী, নজমুল হোসেন চৌধুরী, সাহিত্য ও মুসলিম সংস্কৃতির পথিকৃৎ দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাবসহ তৎকালীন সিলেট অঞ্চলের বহু জ্ঞানী গুনীদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি ওই বিদ্যালয়ে। কালের বিবর্তনে ও শিক্ষানুরাগী দেওয়ান ছনুবুর রাজা চৌধুরীর পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্বহীনতার কারণেই ‘দোহালিয়া এমই বিদ্যালয়’টির শিক্ষা কার্যক্রমের বিলুপ্তি ঘটে।
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরীর বড়ভাই দেওয়ান রইছুর রাজা চৌধুরী। দেওয়ান রইছুর রাজা চৌধুরী মধ্যমঙ্গ বিদ্যালয়ে (সিলেট অক্সপোর্ড হিসেবে খ্যাত, ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত) তিনি পড়াশোনা করেন। এই বিদ্যালয়ে একটি উন্নত মানের লাইব্রেরি ছিলো। সেখানে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। পড়তে পড়তে লেখার প্রতি আগ্রহ জন্মে। ১২০ বছর পূর্বে রচনা করেছিলেন ‘ঘোড়া তত্ব’ গ্রন্থ। বইটি ঘোড়ার উপর বর্ণনা বিষয়ে লেখা। বইটি এখনো কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে। সমাজসেবক ও পশুপালনের প্রতি তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। তাদের ভালোবাসতেন। মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, কবরস্থান দান করেছেন।
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী খেলাধুলায় খুবই আগ্রহী ছিলেন। তাঁর জীবনীগ্রন্থ থেকে পাওয়া তত্ত্বানুসারে তিনি বিভিন্ন দল গঠন করেছিলেন। দলগুলোর মধ্যে অন্যতম- ১. মরা ছমই সেখ (গৌলী) ২. মরা মুক্তার আলী (গৌলী) ৩. মরা বাদশা তালুকদার ৪. মরা সিজিল ৫. মরা খতিল উল্যা (খতই) ৬. মরা গনরাজ ৭. মরা মনা উল্লাহ ৮. মরা আব্দুল জব্বার তালুকদার ৯. মরা ইলিয়াস আলী ১০. স্বর্গীয় রাজা অনাথ বন্ধু চৌধুরী ওরফে সানুবাবু (বেক), ১১. স্বর্গীয় অনীল চন্দ্র পুরকায়স্থ ওরফে অমূল্য বাবু (বেক), দোয়ারা স্টেটের নায়েব ১২. মরা দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী
দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী জমিদারি পেশার পাশাপাশি প্রায় ১০-১২ বার বছর হোমিওপ্যাথি ডাক্তারীর পেশায় যুক্ত ছিলেন। সমাজসেবা অনেক কাজ করেছেন। পাকিস্তান আমলের সরপঞ্জ (ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদমর্যাদা) প্রথা শুরুর থেকে শেষ পর্যন্ত দোহালিয়া ইউনিয়নের সরপন ছিলেন।
রউফুর রাজা গানের প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। ভালোবাসতেন গান। তাই তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের পান্ডুলিপি জৈনক এক ব্যক্তি নেয়ার পরে আর ফিরিয়ে দেননি। বাউল শিল্পিদের দিয়ে গানের সুর করাতেন। সর্বশেষ তত্ত্বানুসারে ২৫০ গান এখনো লিপিবদ্ধ আছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার পরিবারের অনেকে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করতেন। কিন্তু দেওয়ান রউফুর রাজা চৌধুরী জমিদারের ইতিহাস পর্যালচনা করলে দেখা যাবে, তাদের সুনাম ছাড়া কোনো দুর্নাম ছিলো না। এখানে হিন্দু জমিদারের পতনের পর মুসলমান জমিদারের পত্তন হয়। কিন্তু এই এলাকায় সকল ধর্মের মানুষ ছিলো শান্তিতে।
লেখক:
আবদুল কাদির জীবন
নির্বাহী সম্পাদক, আকাশ বাংলা ডটকম